লেখাপড়া ও বিদ্যাশিক্ষা
ফটুকি বড় হয়েছে; এখন তার বয়স দশ। রঙের জৌলুস আরও বেড়েছে। চুলের রাশি ঝরে
পড়েছে কোমর ছাড়িয়ে। কুঁচবরণ কন্যা, তার মেঘবরণ চুল। লেখাপড়া শুরু হয়েছে তার ঘরকন্যা
শিক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে পিতার কাছে। বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক প্রভৃতি শিখেছে সে
ভালভাবে। পিতা, কন্যার কৃতকার্যতায় খুশি, তৃপ্ত; আর তার বিদ্যার্জনের আগ্রহ দর্শনে চমকিত।
তাই তিনি বালিকা কন্যাকে ভর্তি করে দিলেন পাবনা সদরের প্রথম শ্রেণীর একটি বালিকা
বিদ্যালয়ে। রাত্রিবেলা পিতা কন্যাকে নিয়ে বসেন শিক্ষার তত্ত্বাবধানে। জননীও তৃপ্ত হন কন্যার
লেখাপড়ার উন্নতি দর্শনে। কিন্তু মেয়ে ক্রমশ বড় হচ্ছে; এখন এগারাে বছর বয়স। মেয়ের
বিয়ের জন্য মা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। একদিন দ্বিপ্রহরিক আহারের সময় স্বামীর কাছে নিবেদন
করলেন মনের কথা–কন্যার বিবাহ। সেই সূত্রে হিমাইতপুরের চক্রবর্তী বাড়ির বড় ছেলেটির
কথা বলেন। হিমাইতপুরের চক্রবর্তীরা তাদের পাল্টি ঘর। বনেদী পরিবার, সৎ বংশ, সম্পন্ন
গৃহস্থ, সচ্ছল সংসার। ঐ ঘরে ফটকি পড়লে মেয়ে সুখী হবে।
বিবাহ
কন্যার পিতা রামগােপাল বাবু হিমাইতপুরের চক্রবর্তী পরিবারকে ভালভাবেই জানেন। ঐ
বাড়ির গৃহকর্তা শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে তার চাক্ষুস পরিচয় আছে। ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র
শিবচন্দ্র চক্রবর্তী তার শ্বশুরালয়ে কোন পুরুষ অভিভাবক না থাকায় তিনি নিজেই এখানে এসে
বসবাস শুরু করেছেন। শ্বশুর রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী অকালেই পরলােকগমন করার জন্য বিধবা
কৃষ্ণসুন্দরী দেবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড়ই বিপন্ন হয়ে পড়েন। এমনকি জমি-জায়গাও সব
নিলামে চলে যায়। শিবচন্দ্র চক্রবর্ত্তী নিজের নামে সেগুলি খরিদ করে সম্পত্তি উদ্ধার করেন
এবং স্ত্রী মনােমােহিনী দেবীকে নিয়ে থেকে যান শ্বশুরালয়ে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র অনুকূলচন্দ্র গােপাল
লাহিড়ী ইনস্টিটিউশনে রামগােপাল বাবুরই ছাত্র। তিনি তাকে ভালভাবেই, চেনেন। ছেলেটি
অত্যন্ত সুন্দর, মেধাবী, নম্র, বিনয়ী ও অমায়িক স্বভাবের। অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান, সদালাপী এবং
কৃষ্টিসম্পন্ন অভ্যাস ব্যবহারে। কিন্তু স্কুলমাস্টার রামগােপাল বাবু সাহস পান না, ঐরকম একটি
পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে; মনের কথা মনেই চেপে রাখেন। ওদিকে অনুকূলচন্দ্র
ফার্স্ট ক্লাসে পড়ছে, বয়স সতেরাে, বাড়ন্ত গড়নের ছেলে, স্বাস্থ্যবান, লােকপালী স্বভাব, দরদী
হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। গ্রামবাসীদের হৃদয়ের মণি। মা মনােমােহিনী দেবী দীক্ষা নিয়েছেন হুজুর
মহারাজের কাছ থেকে। গুরুর আদেশ নিয়ে নিজে থেকেই দীক্ষা দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ পুত্র
অনুকূলচন্দ্রকে। বীজমন্ত্র প্রদান করেছেন জননী পুত্রকে। দীক্ষাগ্রহণের পর থেকে অনুকূলচন্দ্র বদলে
গেছেন, হয়ে উঠেছেন ধীর, স্থির, গম্ভীর; কেমন যেন অস্বাভাবিক নীরবতা উদাসীনতা তাকে
ঘিরে ধরেছে। খেতে বসে ধ্যানস্থ হয়ে যান। স্কুলে গিয়েছে নাতি, পথের মধ্যে পড়ে আছে
বেহুশ হয়ে, কাপড়জামা কর্দমাক্ত, বই খাতা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। পাড়ার দুধওয়ালা দেখতে
পেয়ে ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। কৃষ্ণসুন্দরী দেবী উঠে পড়ে লেগেছেন নাতির বিয়ে
দিতে। মনে করছেন চাদপানা বউয়ের মুখ দেখলে এই উড়ু উড় ভাব রােগ কেটে যাবে। শিবচন্দ্র
বাড়ি ফিরে এসে সব শুনলেন শ্বাশুড়ির কাছে। গৃহিণী সবসময় পুজো, জপতপ নিয়ে থাকেন।
সুতরাং তিনি মনে মনে ছেলের বিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। দু'একটি জায়গায় সম্বন্ধ এলাে,
কিন্তু বিধির বিধান। পত্নীর প্রস্তাব মতাে রামগােপাল ভট্টাচার্যের কন্যাটিকেই পুত্রবধূ রূপে ঘরে
আনতে মনস্থ করলেন।
ওদিকে কন্যার মাতা, কন্যার পিতা রামগােপাল ভট্টাচৰ্য্যকে পাত্রের পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর
নিকট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর শুরু হল মেয়ে দেখার পালা। ভট্টাচাৰ্য্য পরিবারকে চক্রবর্তী
পরিবার জানিয়ে দিল, অনুকূলচন্দ্র শুধু তাদের একার ছেলে নয়, সে সমগ্র গ্রামবাসীদের প্রাণ,
অন্তরের ধন—হৃদয়ের নিধি। সবাই আসবে তাদের হৃদয়ের মণি অনুকূলচন্দ্রের পাত্রী নির্বাচন
করতে। হিমাইতপুর থেকে দলে দলে লােক আসে ত্রিনয়নী দেবীর কন্যাকে দেখতে। মেয়ে
সকলের-ই পছন্দ—যেন লক্ষ্মী প্রতিমা। যেমন গাত্রবর্ণ, তেমন গড়ন, আয়তচক্ষু—সবচেয়ে সুন্দর
চরণযুগল, এর সঙ্গে সকলেই মিল খুঁজে পায় লক্ষ্মীপূজার দিনে আলপনায় অঙ্কিত চরণচিহ্নের
হবু শ্বশুর, শাশুড়ি সকলেই সরসীবালাকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাদের পছন্দের বার্তা
রামগােপালের গৃহে পৌঁছে গেল। সানাই বেজে উঠল। ২৮শে শ্রাবণ বিয়ের দিন স্থির হল।
বিবাহের সংবাদ জেনে বহু কন্যার পিতাই শিবচন্দ্রের কাছে যােগাযােগ করেছিলেন, অনেকে
কাকুতি মিনতিও করেছিলেন যদি বিয়েটা ঘটে। অনেকে তাদের কন্যার রূপ-যােগ্যতা-
বংশপরিচয়-গৃহনৈপুণ্যতা অনেক কিছুরই বর্ণনা দিয়ে দেখাশােনার জন্য আবেদন পত্রের মতােই
চিঠি দিয়েছিলেন। তখনও অনুকূলচন্দ্র বিবাহে রাজী নন। তার মনে নারী সম্বন্ধে কেমন যেন
একটা সন্ত্রম। তারপর আছে মনের সঙ্গে বােঝাপড়া। তখনও ঠিক করতে পারছেন না।
অনুকূলচন্দ্র অনেক ভাবনাচিন্তার পর সিদ্ধান্তে এসেছেন তার জীবনটা কি। ভাবেন তার সঙ্গে
যে কোন সাধারণ নারীর বােঝাপড়া করে সংসার পালন ঘটবে কি? ভয় হয় তার। এইরকম
একটা সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাড়ির পুরাতন ও বিশ্বস্ত ভৃত্য শশীদাদাকে তিনি নিজের মানসিক
অবস্থাটা খুলে বললেন এবং শশীদাদা শিবচন্দ্রকে তাঁর পুত্রের মানসিক ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেন।
এরপরই পিতা শিবচন্দ্র রামগােপালের কন্যা ফটকির সঙ্গে পুত্রের বিবাহের যােগাযােগ করলেন।
উভয় পক্ষই এই প্রস্তাবে খুশি। দুই বাড়িতেই আনন্দের বন্যা বয়ে এল। ১৩১৩ সালের ২৮শে
শ্রাবণ মহাসাড়ম্বরে অনুকূলচন্দ্রের সাথে সরসীবালার শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়ে গেল।
Comments
Post a Comment