সংসার জীবন
দিদিমার সাধের নাতনি হিমাইতপুরের চক্রবর্তী বাড়ির বড়বৌ হয়ে এলেন এগারাে বছর
বয়সে। বিরাট সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ, আত্মীয়-কুটুম্ব, গরুবাছুর, দাসদাসী নিয়ে
জমজমাট সংসার। তিনি সেই অল্প বয়সে বিরাট সংসার দেখে ঘাবড়ে গেলেন না। তিনি যােগ্য
দায়িত্ব নিয়ে সেই সংসারকে সুষ্ঠু পরিচালনায় অংশ নিলেন। পুত্রবধূর সংসারে এরূপ নিষ্ঠা দেখে
শিবচন্দ্র স্ত্রীকে বললেন—ঐটুকু মেয়ে কি সব পারে। তখন স্ত্রী উত্তর দেন—কি করে জানবাে,
বৌমা তাে কোনটাতে ‘না’ করে না। সবেতেই ঘাড় নেড়ে সাড়া দেয়। অসীম ধৈৰ্য্য ধরে সব
কাজই তাে সম্পন্ন করছে। তখন শিবচন্দ্র বললেন—তােমার বােঝা দরকার। ঐ ছােট্ট মেয়েটা
কেনই বা শ্বশুরবাড়িতে গুরুজনের মুখের ওপর কথা বলবে। বাড়ির গৃহিণীর তাে সেদিকে লক্ষ্য
থাকবে যে ছােট্ট মেয়েটা সারা দিন-রাত খাটা-খাটুনি করছে। এমনি করেই শ্রীশ্রীবড়মা নানাবিধ
সংগ্রামের মধ্যে চক্রবর্তীদের সংসারের সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠেন।
অনুকূলচন্দ্র এন্ট্রান্স ক্লাসের ছাত্র, সতেরাে বছরের কিশাের, গ্রামের সকলের প্রিয়, গ্রামবাসীদের
হৃদয়ের ধন। কত্তামায়ের (ঠাকুরমার) অতটা আবার পছন্দ নয়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হন, খিটখিট
করেন অনুকূলচন্দ্রকে তাঁর পরােপকার নেশার জন্যে। ঘরে কিছু থাকবার উপায় নেই। কখন
কার কী অভাব হয়েছে, ঘর থেকে তা নিয়ে সেই অভাব পূরণ করেন তিনি। রাগে গরগর করেন, ছেলের মা-ও হয়েছে তেমনি, সব কাজেই ছেলের সহায়। ছেলে এসে মার কাছে দীন-
দরিদ্রের অভাব অভিযােগের কথা বলতেই মা’র অন্তর গলে যাচ্ছে আর ছেলেকে সে বিষয়ে।
সাহায্য করছে। একটি বারও বাধা দেওয়া নেই। এরই মাঝখানে এসে পড়লেন সরসীবালা এই
সংসারের বড়বৌ হয়ে। যা ছিল স্ফটিক স্বচ্ছ, স্থির গম্ভীর তাই রূপান্তরিত হয়ে গেল গভীর
সরােবরে, অতলান্ত ব্যাপকতায়। ঠিক সময় এসে গেলেন মা-লক্ষ্মীনারায়ণকে সামাল দিতে
নয়, পাশে দাঁড়িয়ে অথবা অন্তরালে থেকে নারায়ণের সমস্ত কিছু ভাব লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যকে
পরিপূর্ণভাবে উদ্ভিন্ন করে তুলতে। তাই শ্রীশ্রীবড়মার ভূমিকা শিবচন্দ্র মনােমােহিনীর সংসারে
প্রথম থেকেই নেপথ্যে থাকলেও, অন্তরালবর্তিনী হলেও তার ছিল অন্যতম মূল সঞ্চালকের
ভূমিকা। মাতা মনােমােহিনী দেবী জানতেন, অনুকূলের সংসার হবে ভবিষ্যতে জগৎ-সংসার।
অগণিত মানুষ এবং ভক্তের দল কেবল বাড়তেই থাকবে তার পুত্রকে ঘিরে। আর এই জাগতিক
সংসারের খাওয়া-দাওয়া, থাকা শােওয়া ইত্যাদি নানারকম সেবাকার্য বধূমাতা সরসীবালাকে
সামাল দিতে হবে। সামাল তিনি দিয়েছিলেন আজীবন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ব্যক্তিজীবন, লােকপালী জীবন এবং ভবিষ্যৎ জীবন—সমস্ত ক্ষেত্রেই শ্রীশ্রীবড়মা
প্রকৃত অর্থেই শ্রীশ্রীঠাকুরের সহায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই ঠাকুর একদিকে যেমন
বলতেন যে “বড়বৌ গিন্নী ও, বড় পাকা গিন্নী, বড়বৌ যেমন সুশৃঙ্খলভাবে অল্পের মধ্যে সংসার
চালায়, এমন আজকাল খুব কম দেখা যায়। কৰ্ত্তামা-র গালাগালি ওকে মানুষ করে দিয়ে গেছে।
কৰ্ত্তমা-র কড়া শাসন ছিল, আবার ভালওবাসতেন খুব।”—স্থিতধী স্থির প্রজ্ঞার অধিকারিণী বড়মা
না থাকলে শ্রীশ্রীঠাকুরের যে বর্ণবহুল লােকজীবন তা অনেকটাই ব্যাহত হয়ে যেত। তাইতাে
নারায়ণের সংসারে লক্ষ্মীর বড় প্রয়ােজন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাই বারবার বলতেন, কৰ্ত্তামা
বড়বৌ-এর সঙ্গেই সংসারের ব্যাপার নিয়ে পরামর্শ টরামর্শ করতেন। বড়বৌ-এর সংরক্ষণ বুদ্ধিকে
কৰ্ত্তামা খুব পছন্দ করতেন এবং বলতেন—তােমার কাছে যদি কিছু থাকে, অনুকূলকে বা তােমার
শাশুড়িকে কয়াে না, একবার টের পেলে আর রক্ষে নেই। শ্রীশ্রীবড়মার এই সংরক্ষণী মনােবৃত্তির
একটি সুন্দর উদাহরণ ঠাকুর উপস্থিত করেছেন। এক ঋত্বিক দাদা শ্রীশ্রীঠাকুরকে দীক্ষা প্রণামী
২৯২ টাকা আট আনা নিবেদন করায় তিনি তা শ্রীশ্রীবড়মাকে দিতে বললেন। উক্ত দাদা
শ্রীশ্রীবড়মাকে ঐ টাকা দিতে যাবার পর শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—বড়বৌ খুব মজা করে। এইসব
টাকা যে দেওয়া হয়, আমি হয়তাে কুড়ি টাকা শৈলর খাবার জন্য চেয়ে নিলাম। তখন বলে,
অযথা এ টাকাটা খরচ করে কি লাভ? আমি বলি—তুমি যে এত পেলে? ও তখন বলে—
যা পেলাম তা পেলাম। কিন্তু এই খরচটার তুমি কি পেলে? ওকে ঐভাবে খাইয়ে ওর পেট
খারাপ করে, তােমারও টাকাগুলি যায়। ওরও যদি কোন লাভ হতাে তাহলে না হয় বুঝতাম।
ওর কথাও ফেলবার মতাে নয়। বড়বৌ যেন পােস্ট অফিসের বাক্স, একবার চিঠি ফেললে
ইচ্ছামতাে তা বের করার উপায় নেই। (সূত্র ও আলােচনা-প্রসঙ্গে, অষ্টাদশ খণ্ড)
Comments
Post a Comment