ঠাকুরের নির্দেশানুযায়ী তৎক্ষণাৎ রান্নাবান্না
শ্রীবড়মা সবসময় ঠাকুরের শরীরের দিকে নজর রেখে, দরকার হলে ডাক্তারদের সাথে
পরামর্শ করে তার ভােগের ব্যবস্থা করতেন। কখনও কখনও ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে সেই সেই
তরকারি রান্না করতেন। একদিন ঠাকুর মেঠো কলমী শাক রান্নার কথা বললেন। তখন মা কালাে
জোয়ার্দার-কে ডেকে বললেন, তাের বাবাকে খবর দে—মেঠো কলমী শাক ঠাকুরের জন্য
পাঠাতে। কালাের বাবা আশু জোয়ার্দার-দা তখন কলকাতা সৎসঙ্গ-কেন্দ্রে থাকতেন। কালাে
তার বাবাকে গেনে এবড়মার কথা জানালেন। আশুদা একটি লােককে যাওয়া-আসার
খরচপত্র দিয়ে রাতের ট্রেনেই পাঠিয়ে দিলেন। সেই ভােরেই শাক এসে পৌঁছে গেল। মা
নিজহাতে শাকগুলি বেছে কুটে—তার সাথে পটল, আলু, কাঁঠালের বীচিসহ এমন সুন্দর তরকারী
চুনীলাল রায়চৌধুরী বড়মার জীবনের নানা ঘটনা বর্ণনায় একজায়গায় বলছেন—রান্নাবান্না
প্রস্তুত। বাবর আসন করে দেওয়া হয়েছে। স্বামী খেতে বসেছেন। আহাৰ্য্যবস্তু আনবার জন্য
বধটি (
এবড়মা) হেঁশেলে ঢুকেছে। হঠাৎ স্বামী বললেন, আমি খিচুড়ি খাব। সে কি? আজ
তাে খিচুড়ি রান্না হয়নি। কিন্তু কে শুনবে সে কথা? খিচুড়ি তার চাই এবং তক্ষুনি চাই। ঠিক
আছে। খিচুড়িই আনছি। তখনই বধূটি রান্নাঘরে ঢুকে যায়। একটু পরেই খিচুড়ি এনে হাজির
করে। ভাতে ভালে মিশিয়ে কেমন করে কি কৌশলে যে তক্ষুনি খিচুড়ি প্রস্তুত করে আনে,
তা বধটিই জানে। কোনদিন হয়তাে খেতে বসে স্বামী বললেন, আজ ঘি-ভাত খাব। ঠিক আছে।
বিভাতই এনে পরিবেশন করছি। তক্ষুনি মাথা খাটিয়ে ভাতের সঙ্গে ঘি-গরম মশলার সমাবেশ
ঘটিয়ে অতি সুস্বাদু ঘি-ভাত এনে হাজির। কিছুতেই যেন তাকে নিরস্ত করা যায় না।
কিছু
২z
C১১
যামিনীকান্ত রায়চৌধুরীর একটি অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হল—এবার রসুই ঘরে কুললক্ষ্মী।
দক্ষী হয়ে—চৌকস নজর ফেলছে। ভেজালী চলার ধার ধারা দায়। চালের আধারগুলাে। দল
বেঁধে রকমারী রকম নিয়ে দখল নিয়ে আছে নির্দিষ্ট একটি জায়গায়। তৈলাক্ত পদার্থেরা, তারাও
ভিড় করেছে নির্দিষ্ট স্থানটিতে। এমন করে কিউ মেরে দাঁড়িয়ে মশলার দল, ক্ষার পদার্থ
কত কি! বৈচিত্র্যের ছন্দ বাঁধা যাত্রী। টুলের ওপর বসে বড়মা করেন কি? দেখলাম
তরকারিগুলাে তিন থাকে সাজানাে। একটা শক্ত, একটা মাঝারি, একটা নরম। শক্ত আলু।
কচুগুলােকে কড়াইয়ের ভেতর ছেড়ে দিলেন। উদ্দেশ্য জল দিয়ে ভাপিয়ে নেবার জন্য।
সময় পেরিয়ে গেল, ঝিঙ্গে, পটল সেই পাত্রেই ঢুকে পড়ল এবার। একটু সময় বাদেই যাত্রিক
হলাে কচি ডাটারা। তা হলাে সবগুলােকে সমানভাবে সিদ্ধ করে সিদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া।
ছােট্ট একটা পেঁপের ঝােল। লম্বা আর পাতলা অবয়বে চেয়ে আছে। মা ঐ পেঁপেগুলাে
উনানে তেল চাপিয়ে মেথি আর কাঁচা লঙ্কাকে সহযােগী করে কষে ফেললেন। অল্প জলে অল্পই
সিদ্ধ হল। আর কোন মশলা ছোঁয়া লাগাতে হল না। যার জিভেই পড়ল, সেই আওয়াজ তুলল—
“আর একটু চাই মাগাে।” মায়ের রান্না শুধু রকমারি ছিল না, পরম উপাদেয় আর পুষ্টিকরও
ছিল। ধীরেনদা সরষের তেল দেবার ব্যাপারে একটু কার্পণ্য করলে বলতেন—“এ দেশ একটু
খসখসে, তাই একটু বেশি তেল দিবি।
রন্ধন ও ঘরকন্নার ব্যাপারে আরও দু'একটি ঘটনা বড়মার সংরক্ষণী দক্ষতার পরিচয় দেয়।
একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীবড়মার কাছে উঁচড়ের ডালনা খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
শ্রীশ্রীবড়মার রান্না তখনও কিছু বাকী। হঁচড়ের সময় তখন নয়। মায়ের নির্দেশে শ্রীশ্রীবড়দা
তক্ষুনি আশ্রমের সমস্ত গাছে হঁচড়ের সন্ধানে লােক পাঠিয়ে নিজেও সন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু
সবাই ফিরে এল খালি হাতে। শ্রীশ্রীবড়মা নিরাশ না হয়ে বললেন—আরও খুঁজতে হবে এবং
পাওয়া যাবে নিশ্চয়। ঠাকুরভােগের সময় আগতপ্রায়। শ্রীশ্রীবড়মা উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের
বারান্দায়। হঠাৎ দেখা গেল বড়মার রান্নাঘরের পিছনের কাঁঠাল গাছটার একবারে মগডালে একটা
ইচড়। ডালনার উপকরণ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল বড়মার। কয়েক মিনিটের মধ্যে অতি সুস্বাদু
ইচড়ের ডালনা প্রস্তুত করে ঠাকুরভােগের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করলেন। ব্যাকুলতা নিয়ে পরমপুরুষের
সেবায় নিযুক্ত থাকলে সেবকের প্রয়ােজন পূরণ করেন পরমাপ্রকৃতি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কখন কী প্রয়ােজন তা নিজে বুঝে আগে থেকে সংগ্রহ করে রাখতেন
শ্রীশ্রীবড়মা। শ্রীশ্রীঠাকুর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ভেড়ামারার সােনামুখী মুগডাল খাবেন। তখন
বাতের ব্যথায় শ্রীশ্রীবড়মার হাঁটা-চলায় কষ্ট। সবাই চিন্তায় পড়ে গেল-ভেড়ামারা বাংলাদেশের পাবনার একটি বিশেষ জায়গা। দেওঘরে এখন সেই ডাল কোথায় মিলবে? গত্যন্তর না দেখে
সবাই ছুটল বড়মার কাছে। বড়মা সব কথা শুনে বলেন—তার ভাড়ার ঘরের খাটের নীচে
তিন নং হাঁড়ির একটা কৌটার মধ্যে কাপড়ে বাঁধা পুটলিতে আছে ভেড়ামারার সােনামুখী
মুগডাল। ঠাকুরের ইচ্ছাপূরণ হল। শ্রীশ্রীবড়মার ঠাকুরসেবা এই রকম। তাঁর ভালবাসা এত
স্বতঃস্ফূর্ত যে প্রভু কি বলতে পারেন, কি চাইতে পারেন, তা আগে থেকে বুঝে জোগাড় করে
রাখা তার সেবার জন্য।
(সূত্র : জয়তু জননী মে, পৃঃ ৫৭-৫৮)
বড়মার পৌত্রীর ভাষায়—“বামুন খাবার নিয়ে আসতাে। যেখানে ঠাকুর-ভােগ হত সেখানে
ঠাকুমা পরিবেশন করতেন। বাবাকে, কখনও কখনও বড়পিসিমাকে দেখেছি ভােগের ওখানে।
বামুন সাজিয়েই নিয়ে আসতাে ঠাকুমার নির্দেশমত, পরে যা লাগতাে ঠাকুমাই দিতেন। ঠাকুমা
সব কাজই ছবির মতাে গুছিয়ে করতেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ‘নিট অ্যান্ড ক্লিন’। আধিক্য নেই,
কিন্তু আর্টিস্টিক। সব কাজই সুন্দরভাবে করতেন, সিপিল, কিন্তু গরজা। মাথার সিন্দুর থেকে
পায়ের নখ অবধি সবই পরিচ্ছন্ন। ঠাকুমা লক্ষ্মীবিলাস তেল ব্যবহার করতেন সারাজীবন। যতদিন
নিজেকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে পেরেছেন, ঐ ব্র্যান্ড কখনও চেঞ্জ করেননি। আমি কখনও
ঠাকুমাকে কপালে সিন্দুরের টিপ করতে দেখিনি। আমার বিয়ের পর তিত্তিরিদি যখন ঠাকুমাকে
চানটান করাতাে, তখনই পরিয়েছে। ঠাকুমা তরকারী কাটতেন—হাতে আঙ্গুলে দাগ লাগলে,
সেগুলাে বসে বসে লেবু দিয়ে ঘসে ঘসে উঠাতেন। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি
করছাে? বল্লেন, তাের দাদুকে খাওয়াবাে তাে, তাই পরিষ্কার করছি। আমি ঠাট্টা করে হাসলাম,
ঠাকুমাও হাসলেন।” (সূত্র ঃ তােমরা সবাই কোথায় গেলে–কল্যাণী মৈত্র, পৃঃ ৩৭)
Comments
Post a Comment