বড়মা প্রকৃত অর্থে লক্ষ্মী মা
শ্রীশ্রীঠাকুরই ছিলেন বড়মার জীবনে একমাত্র লক্ষ্যস্থল। ব্যক্তিগ ভাবে তার সেবা, বাস্তব
অর্থে তার পরিচর্যা করা, তিনি যাতে খুশি হন, তৃপ্ত হন, আনন্দিত হন, সেদিকে তিনি কড়া।
নজর রাখতেন। একই দেহে তিনি যে লক্ষ্মী-নারায়ণ, অজস্র ঘটনা থেকে একটি ঘটনা তুলে
ধরলে তার সত্যতা প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করা যাবে—একবার জামতলা ঘরে এয়ার কুলার
লাগানাের জন্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের ডানহাত অসাড় হয়ে যায়। এই অসুস্থতা চলে ৪২ দিন ধরে।
শ্রীশ্রীবড়মা ঐ ৪২ দিন অন্নত্যাগ করেছিলেন। শ্রীশ্রীবড়দার আব্দারে তিনি আধগ্লাস করে লেবুর
সরবত খেয়েই শ্রীশ্রীঠাকুরের দিন-রাত সেবা শুশ্রুষায় নিমগ্ন থাকতেন। এই দীর্ঘকাল অনাহারে
থাকার জন্যে তার দেহে কোন দুর্বলতার প্রকোপ দেখা যায়নি। দিব্য জ্যোতিতে তার মুখমণ্ডল
উজ্জ্বল থাকত। শ্রীশ্রীঠাকুর যতদিন না সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন, ততদিন শ্রীশ্রীবড়মা এইভাবেই ঠাকুরের
অক্লান্ত সেবায় দিন কাটিয়েছেন।
ধীরেন ভূক্তদার লেখায় উপরােক্ত ঘটনার সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যায়—শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য
জামতলায় একটি ঘর করা হল। ঠাকুর দুপুরে শুয়েছিলেন, খুব গরম পড়েছিল, তাই ঐ ঘরে
হিউমিডিফায়ার মেসিন বসানাে হয়েছিল। সেই ঠাণ্ডায় ঠাকুরের ঐ স্ট্রোক। তখন বেলা ৪টা
নাগাদ হবে। ঠাকুর ঘুম থেকে উঠেই আমায় বললেন—‘বড়বৌ কনে রে?” আমি মাকে এবং
ডাঃ প্যারীদাকে ডেকে এসে দেখি ঠাকুর পায়খানায় গেছেন। মা ঘরের ভিতরে বসে আছেন।
আমি প্রতিদিনের মতাে এদিনও বিছানা ঠিক করে আবার বালিশগুলি যথাস্থানে রেখে দিলাম
ঠাকুর পায়খানা সেরে ঘরে ঢুকেই মার দিকে তাকালেন। মা তখন দাঁড়িয়ে আছেন। মা ঠাকুরের
কাছে দাঁড়ালেন। ঠাকুর একটি পা বিছানায় তুলেই মাকে বললেন—দেখ বড়বৌ! বলছেন আর
গালের দিকে হাত তুলে দেখাতে গিয়েই অমনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ঠাকুরের ঐ অবস্থা
দেখেই বিছানার ধারে এসে ধরে নিলেন। তা না হলে ঠাকুর হয়তাে মাটিতে পড়েই যেতেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের মুখ, হাত (ডানদিকটা) কেমন বেঁকে গেল। তক্ষুনি বড়দাকে খবর দেওয়া
হল, ছােড়দা এসে গেলেন। বড়দা এসেই কলকাতায় খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ৪০ নং
বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রীট থেকে বড়বৌদি ও তার ছেলেরা সবাই এসে গেল। কিরণদা প্রথমে ডাঃ
জে. সি. ব্যানার্জীকে নিয়ে এলেন। পরে পরে ডাঃ জে. সি. গুপ্ত, তাপস রায়, অমিয় রায়চৌধুরী
এলেন। তখন সে কি একটা পরিস্থিতি। পূজ্যপাদ বড়দার আর সমস্ত কাজ ফেলে বাবাকে ভাল
করার সেকি প্রচেষ্টা। এইখানেই তাঁর রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হল। সে-সময় মাকে দেখেছি
কেমন চিন্তিত এবং সর্বদা শ্রীশ্রীঠাকুরের পাশে বসে সেবায় নির। নিদ্রা, আহার সব তখন
তার কাছে গৌণ। এমন করে দু’দিন কেটে গেল বিনা আহার ও নিদ্রায়। কেবল মাঝে মাঝে
এক ঢােক জল খান আর একটা পান মুখে দেন। একথা বড়দাকে আমি জানালাম। বড়দা শুনে
আমায় বললেন—তাের এখন সময় নেই। বাড়ি থেকে, সত্য শৰ্মা ভাল নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ওকে
দিয়ে কিছু ফলের রস পাঠাব, তুই মাকে খাওয়াবি। বড়দা তাই করলেন। কিন্তু শেষে তিনি
নিজেই এলেন, আদরের সুরে বললেন—মা, এই রসটা সত্য তােমার জন্য করে এনেছে। ও
খুব নিষ্ঠাবান। তুমি এইটা খেয়ে নাও।
প্রথমে মা বললেন—আগে ঠাকুরকে সারাবার ব্যবস্থা কর—তারপরে। বড়দা এবার মাকে
আরও আদর করে বললেন—মা, ডাক্তার যতই আসুক—তােমার আশীর্বাদে বাবাকে সারাবাে।
আজ ডাক্তারবাবু অবস্থা একটু ভাল বললেন। তােমার যদি শরীর ভাল না থাকে, তবে বাবাকে
সারানাে সম্ভব হবে না। তুমি যে আমার শক্তিময়ী মা! এবার মা সেই ফলের রসের গ্লাসটা
বড়দার হাত থেকে নিয়ে পান করলেন। আমি অমনি একটা পান হামান দিস্তায় ছেচে এনে
দিলাম। একটা পেতলের হামান দিস্তা ছিল, এখনও সেটা মেমােরিয়ায় মা-র সামনে রাখা আছে।
মা-র এবং বড়দার অক্লান্ত সেবায় এবং ডাক্তারদের নিরলস প্রচেষ্টায় শ্রীশ্রীঠাকুর সুস্থ হয়ে।
উঠেছিলেন।
মা এগারাে বছর বয়সে চক্রবর্তীদের সংসারে এসে সেই বাড়ির বিশাল যজ্ঞের ভার নিজের
হাতেই নিলেন। বধূজীবনে প্রবেশ করেই তাকে সেই সংসারের সব ভার নিতে হল। তিনি গৃহলক্ষ্মী
সাজলেন, সংসারের সব কাজ নিজের হাতে নিলেন এবং শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবরদের সেবায়
জীবন কাটাতে লাগলেন। এমনি করেই শ্রীশ্রীবড়মা সংসারটাকে সুন্দর ও শ্রীতে পরিপূর্ণ করে
তুললেন।
প্রবীণ কর্মী দুলাল মজুমদারের বহুমূল্য অভিজ্ঞতায় তার প্রকাশিত মন্তব্য—তার কর্মনিপুণতা,
সেবা, দক্ষতাকে প্রকাশের মতাে উপযুক্ত বিশেষণ পাওয়া যায় না। সৎসঙ্গ আন্দোলনের প্রথম
দিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে যারা থাকতেন, এবং বাইরে থেকে যারা আশ্রমে যেতেন, তাঁদের
সবারই খাওয়ার পর তিনি নিজে যখন খেতে বসতেন, তখন ভাত ছাড়া আর কিছুই থাকতাে
। তাই ডালে ফোড়ন দেওয়া লঙ্কাগুলাে তিনি তুলে রাখতেন এবং তাই দিয়েই তিনি দিনের
পর দিন নিঃশব্দে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেন। অনেক পরে এ জিনিস জানাজানি হয়েছিল। আশ্রমিকরা
তাকে লক্ষ্মী মা বলে মনে করতেন। পরবর্তীকালে আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠা হয় এবং উৎসব অনুষ্ঠানে
পূজ্যপাদ বড়দা শ্রীশ্রীবড়মাকে আনন্দবাজারে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতেন। কারণ পূজ্যপাদ বড়দার এই
বিশ্বাস ছিল—যে ‘মা’ আনন্দবাজারে ঘুরে গেলে ভাঁড়ারে কখনই টান পড়বে না।
(জয়তু জননী মে, পৃঃ ১৩৩)
Comments
Post a Comment