![]() |
শুভ আবির্ভাব |
কথায় ও ছবিতে শ্রীশ্রীবড়মা
শ্রী শ্রী ঠাকুর কি বলতেন শ্রী শ্রী বড়মাকে নিয়ে
শ্রীশ্রীঠাকুর একবার শ্রীশ্রীবড়মার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবেগ-বিহ্বল কণ্ঠে উপস্থিত শিষ্যদের
উদ্দেশ্যে বলেছিলেন—“আপনাদের ঠাকুর যদি নারী দেহ নিয়ে জন্মাতেন, তাহলে তার যে রূপ
হ’ত তা ঐ বড়বৌ।”—বড়মা ছিলেন জগৎ-জননী, পরমপিতার অংশ-স্বরূপা। বর্তমান
আচার্যদেব পূজ্যপাদ দাদার ভাষায়—দুই দেহে এক অভিন্নসত্তা। পৃথক অস্তিত্ব থাকলেও একই
রূপে পূর্ণ প্রকাশ। পুরুষােত্তম যখন পৃথিবীতে আসেন, তখন তিনি লীলা-সহচরীকে নির্ধারিত
ভাবেই আবাহন করে নিয়ে আসেন। তাদের আলাদা অস্তিত্ব থাকলেও, দুই দেহ থাকলেও তারা
যে একে একে দুই নয়, বরং একে একেই পূর্ণ এক—তারই প্রকটিত রূপে দেবলােক থেকে
মর্তলােকে ধরা দেন। রাধিকার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করেই যেমন নবদ্বীপচন্দ্র শ্রীগৌরাঙ্গের
আবির্ভাব। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকার প্রেমের মহিমা, প্রেমের স্বরূপ, প্রেমের মাধুর্য
আস্বাদনকল্পে বিশ্ববাসীকে জানাতে এবং নিজে অনুভব করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
চৈতন্যচরিতামৃতে তাই বলা হয়েছে—“রাধিকার ভাবকান্তি করি অঙ্গীকার, নিজ রস আস্বাদিতে
হইয়াছ অবতার। রাধাভাব-দ্যুতি সম্বলিত গৌর তনু শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাব প্রসঙ্গে বৈষব ।
মহাজনগণ এইভাবেই তাদের অনুভূতি এবং সাধনার মধ্য দিয়ে চিন্তা করেছেন। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর
যখন বলেন—“আপনাদের ঠাকুর যদি নারী দেহ নিয়ে জন্মাতেন, তাহলে তার যে রূপ হতে
তা হলাে ঐ বড়বৌ'। তখন আমরা তার সারমর্ম অনুধাবন করতে পারি।
![]() |
Sri Sri Thakur with Devotees |
শুভ আবির্ভাব
বাংলা ১৩০১ সাল, ১৪ই শ্রাবণ রবিবার কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথি; সারাদিন ধরে বৃষ্টি, টিপটি
করে সারাদিন জল ঝরছে। কৈলাসবাসিনী দেবী সকাল থেকেই ব্যস্ত; একটি কুঁড়েঘরের মধ্যে
প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। চারিদিক পাখির কূজনে, ফুলের সুবাসে ভরপুর। সন্ধ্যে হয় হয়—
রাত্রিদিনের সন্ধিক্ষণ, ঠিক সেই সময়ে গাড়াদহের লাহিড়ী বাড়ির অন্দরমহল থেকে তিন ঝক
উলুধ্বনি; সেই উলুধ্বনি ও শঙ্খের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল পল্লীর ঘরে ঘরে। তুলসীতলায়
প্রদীপ-আরতি রত বধূদের কানে গেল; সকলেই অনুভব করল এই মুহূর্তে লাহিড়ী বাড়িতে
দেবসন্তানের আবির্ভাব ঘটেছে। মাতা ত্রিনয়নী দেবীর কোলে এক দেবকন্যা আবির্ভূত হলেন।
সদ্যোজাত কন্যাকে দেখে সেদিন অনেকেরই মনে হয়েছিল আকাশের এক টুকরাে চাঁদ যেন ধরায়
নেমে এসেছে। এই কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন ত্রিনয়নী দেবী এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের
সামনে ভেসে উঠেছিল অনেকদিন আগেকার একটি সুখস্বপ্ন। হঠাৎ তার মনে পড়েছিল কোজাগরী
পূর্ণিমার সেই ভােররাত্রে আলাের বিচ্ছুরণের মতাে গৃহে গৃহে লক্ষ্মীর ঘট তখনও পাতা। ঘরে
ঘরে আলপনায় আঁকা হয়েছে মা-লায় মঙ্গলময় পদচিহ্ন। পিঁড়িতে পিঁড়িতে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে ।
মঙ্গলচিহ্ন। লক্ষ্মীর ঝাপি ঢাকা রয়েছে লাল-চেলী বসনে। সেদিন ত্রিনয়নী দেবী নীরবে বসে।
পূজা দেখছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন লক্ষ্মীর ঝাপি থেকে বেরিয়ে এলেন লালটুকটুকে
লালপেড়ে শাড়ি পরা এক অনিন্দ্য রূপবতী বালিকা। অপূর্ব তার শ্রীমুখমণ্ডল, টানা টানা কাজল।
মাখানাে চোখে, এক অদ্ভুত প্রসন্নতা ভরা দৃষ্টি। আলতা রাঙানাে পদ্মপাপড়ি সদৃশ নিটোল।
পদযুগল। দেখলেন তার দিকেই মধুর হাসি হেসে শান্তপদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন। ত্রিনয়নী দেবী।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে। হঠাৎ পলক ভাঙতে দেখলেন
সে অপরূপ বালিকা—জীবন্ত লক্ষ্মী প্রতিমা তাঁর কাছে এসে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঘুম
ভেঙে গেলে ত্রিনয়নী দেবীর আর ঘুম হয়নি। ঘুম না হলেও মেয়েটির মুখস্মৃতি তার সুখস্মৃতির
মধ্যে এখনও জমাট হয়ে আছে। ত্রিনয়নী দেবী কন্যার দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখা মুখের আদলের
সাদৃশ্য খুঁজতে খুঁজতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠলেন—এত ভাগ্যবতী আমি! আত্মহারা হলেন
খুশির জোয়ারে।
পরবর্তীকালে নবজাতকের মুখ দেখে শাশুড়ি হরসুন্দরী দেবীও আনন্দপ্রবাহে উচ্ছল হয়েছেন
মেজবৌমার কথায়। পরে বলেছিলেন—এই মেয়েই সাত রাজার ধন এক মানিক। প্রতিবেশীদের
বলেছিলেন—আমার এই আঁধার ঘরে যে এসেছে, তাকে আমি মাথায় তুলে নেব। বুক ভরে
উঠবে তাতে, হয়েছিলও তাই। নবজাতিকাকে কোলে তুলে নিয়ে সেই আনন্দস্বাদ অনুভব করলেন
তিনি। এক অকারণ পুলকের অনুভূতিতে হৃদয়ােচ্ছাসে অভিভূত হলেন, আনন্দে আটখানা হয়ে
মা ষষ্ঠীর পূজা পাঠিয়েছিলেন। হরির লুট দিয়েছিলেন প্রাণভরে। মানত করেছিলেন যা, তার
পূর্ণফল লাভ হয়েছে, তাড়াতাড়ি পত্র লিখে দিলেন বেয়াই-বাড়ি। পুত্রবধূকে যত শীঘ্র পারে
চলে আসার কথা জানিয়েছিলেন, নাতনির মুখ দেখার জন্যে উতলাও ছিলেন। এমনই হয়—
বিশ্বজননীর আবির্ভাব লগ্নে দুনিয়ার সবাই যেন নৈবেদ্য সাজিয়ে অপেক্ষারত থাকেন। কখন তিনি
তা গ্রহণ করবেন। আর তার আবির্ভাব ঘটে এই মর্তভূমিতে মহাকালের নিয়মে।
বাড়ির একমাত্র পুরুষ অভিভাবক ত্রিনয়নী দেবীর দাদা শীতলাকান্ত লাহিড়ী সারাদিন গৃহে
অবস্থান করছিলেন। একসময় তিনি বাইরে গিয়েছিলেন, সাংসারিক প্রয়ােজনে। বাড়ির কৃষাণ
কালু ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল তাকে ‘কত্তাবাবু, দিদিমণির খুকি হয়েছে গাে। কত্তামা
ডাকতি নেগেছেন। দেখবা, আস বাবু—চাদের পারা খুকি।”—শীতলাবাবু কঁাধের চাদরটা তখনই
কালুকে দান করলেন এই শুভ সংবাদ শ্রবণে খুশির আবেগে। পরে বললেন—পরণের
কাপড়খানাও তাের পাওনা রইল, বাড়িতে গিয়ে ছেড়ে দেব। কালু একগাল হেসে ঘাড় কাত
করল—এজ্ঞে কত্তাবাবু। আঁতুড়ের দরজায় ভিড় জমেছে পাড়া-পড়শীদের। বেশিরভাগটা ঝিউড়ী মেয়েদের দল,
গৃহবধূদের দঙ্গল আর গিন্নীদের জটলা। কৈলাসবাসিনী দেবী কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে আঁতুড়ের।
দোরগােড়ায় এসে বসেছেন। প্রসূতি শুয়ে আছেন তার শয্যায়। মিটমিট করে মেয়ের মুখের
দিকে চাইছেন। লক্ষ্মীমা’ বইয়ের লেখিকা এর একটি অসাধারণ সুন্দর বর্ণনা করেছেন—“বলে
আছেন কৈলাসবাসিনী দেবী—কোলে সদ্য-প্রসূত শিশুকন্যা। আঁচলে বিছিয়ে রেখেছেন একরাশ
বেলফুল। দুগ্ধ-শুভ্র সদ্যস্ফুট বেলফুলের রাশি সৌন্দর্য্যে ও সুষমায়, বর্ণে ও গন্ধে দিক উজ্জ্বল
করে ঘর আলাে করে আঁচলে বিছানাে রয়েছে। মাঝে একটি স্থলপদ্ম। সবুজ পত্রে ছাওয়া,
লােহিতাভ স্থলপদ্মের অর্ধস্ফুট কুঁড়িটি পুষ্পরাশির শীর্ষস্থানে পরিপূর্ণ গৌরবে ফুটে আছে।
পিট-পিট করে চাইছে চারিদিকে ভাসাভাসা দুটি গভীর কালাে চোখ মেলে। ও-পাড়ার
রায়-গিন্নী-মা মেয়ে দেখে বললেন– ও মা! ত্রিনয়নীর পেটে না একটা স্ফটিক জন্মেছে। ওর
নাম থাক ফটকি।”
Comments
Post a Comment