দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
সৃষ্টির বিধানে জগতে সব-কিছুর মধ্যেই একটা সীমা বা মাত্রা স্থিরীকৃত হ'য়ে আছে। এই সীমা অতিক্রম ক'রে গেলেই সে-বিষয়টি আর সুন্দর বা কল্যাণকর থাকে না, অনেক সময়ে তা' প্রাণঘাতীও হ'য়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, সৌরজগতের গ্রহগুলি তাদের নির্দ্দিষ্ট স্ব-স্ব কক্ষপথে বর্ত্তমান থেকে অহরহ সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ ক'রে চলেছে। গ্রহগুলি তাদের নিজেদের জন্য নির্দ্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে একটু বাইরের দিকে গেলেই মহাকাশে ছিটকে প'ড়ে এলোমেলোভাবে ঘুরতে থাকবে, আবার একটু ভিতরে স'রে এলে সূর্য্যের প্রচণ্ড আকর্ষণে সূর্য্যের মধ্যে ছিটকে প'ড়ে ভষ্মীভূত হ'য়ে যাবে। বিধাতা-কর্ত্তৃক তাদের জন্য যে সীমাপথ নির্দ্ধারিত হ'য়েছে, তাই তাদের অস্তিত্ব-রক্ষার প্রকৃষ্ট উপায়। আবার দেখা য়ায়, নদী যখন মাত্রামত জলে ভরা থাকে, তখনই ভাল। মাত্রামত জলপূর্ণ না হ'লে নদী নৌবাহনোপযোগী থাকে না, আবার মাত্রা ছাড়িয়ে বন্যাপ্লাবিত হ'লে দুই কুলের ক্ষতি করে। ছোট ছেলে-মেয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে, যখন তারা কোন কাজ ঠিকমত বুঝে ক'রে উঠতে পারে না, তখন আমরা তাদের বলি---- অপরিণত-বুদ্ধি, বোকা বা বেকুব। আবার, তাদের মুখে যখন বড়-বড় কথা শুনি বা তাদের বুড়োদের অনুকরণ করতে দেখি, তখন বলি পাকামি, জ্যেঠামি। কিন্তু তাদের সেই বয়সে যা' মানায়, তেমনতর শিশুসুলভ আচরণ মনে আনন্দই দান করে। এইভাবে বিশ্বজগতের অসংখ্য উদাহরণ এনে দেখানো যেতে পারে যে, বিহিত মাত্রা বা মর্য্যাদাই সৃষ্টির সৌন্দর্য্যকে ধারণ ক'রে রেখেছে। ধর্ম্মের এটি একটি বিশেষ লক্ষণ।
সংহিতায় আছে, বেদবিহিত ও স্মৃতিকথিত আচরণই ধর্ম্মাচার (মনুসংহিতা, ১। ১০৮)। কিন্তু বেদ ও স্মৃতির দ্বারা সমর্থিত হ'লেই শুধু হবে না, নির্দ্দিষ্ট মাত্রা বা মর্য্যাদাও সুরক্ষিত হওয়া চাই। যে-কোন সৎ-আচরণ বা সৎ-গুণ মাত্রাহীন ও যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ ক'রলে তা' তখন আর ধর্ম্মবিধির অঙ্গীভূত থাকে না। পোষা সাপ যেমন হিংস্র হ'য়ে সাপুড়েকে দংশন করে, তেমনি ঐ সৎ-গুণও তখন কুগ্রহ হ'য়ে আমাদের দুরদৃষ্টের সৃষ্টি করে। সেজন্য, পুরাণ, কোরান, সংহিতা সর্ব্বত্রই মর্য্যাদা কেবল কথা বা সন্মানদানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের সর্ব্বক্ষেত্রে সৃষ্টির প্রতিটি বিষয় ও ব্যাপারেই যথাবিহিত মর্য্যাদা রক্ষা ক'রে চলা চাই। আর তখনই সব-কিছু হ'য়ে ওঠে সুখদ, শুভদ, জীবনীয়। এ না ক'রলে আমরা ধর্ম্ম ক'রতে যেয়ে অধর্ম্মেরই সৃষ্টি ক'রে চ'লব। উদাহরণস্বরূপ আমরা মহাভারতের মহাবীর দাতাকর্ণের নাম উল্লেখ ক'রতে পারি। কর্ণের বীরত্ব ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, যোগ্যতা, পরাক্রম, কৌশল প্রভৃতি মানবিক গুণের কিছুমাত্র ন্যূনতা ছিল না। কিন্তু একটা লক্ষণীয় ত্রুটি ছিল তাঁর জীবনে। তিনি 'দান' নামক সদ্গুণে একেবারে অভিভূত ছিলেন। ফলে, তাঁর ইষ্ট সূর্য্যদেব-কর্ত্তৃক প্রদত্ত কবচকুণ্ডলও তিনি বিনা দ্বিধায় অপরকে দান ক'রে দিতে পারলেন। ঐ কবচকুণ্ডল ছিল তাঁর পক্ষে অক্ষয় নআশীর্ব্বাদস্বরূপ। আর, দানগুণে (দোষে ?) অভিভূত থাকার জন্য তিনি তাঁর ইষ্টদেবের স্মৃতিকে অনায়াসেই বিসর্জ্জন দিলেন। ইষ্টের স্মৃতি বিসর্জ্জন দেওয়া ----প্রকারান্তরে ইষ্টকে অর্থাৎ কল্যাণকেই বিসর্জ্জন দেওয়া। আর, তাই-ই তাঁর জীবনে নিয়ে এল নিদারুণ অভিশাপ, যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হ'লেন। এখানে 'দান' গুণ নয়, দোষ ----ধর্ম্ম নয়, অধর্ম্ম।
যথার্থ প্রয়োগবিধি না জানার জন্য এইভাবে আমরা সৎ-কে অসৎ ক'রে তুলি, শুভর ফল অশুভ হ'য়ে দাঁড়ায়। গোখরো-সাপের বিষ দিয়ে জীবনদানকারী ওষুধ তৈরী হয়, কিন্তু ঠিকমত ব্যবহার করতে না জানলে ঐ বিষই জীবনহানির কারণ হ'য়ে দাঁড়ায়। ঘি পুষ্টিকর খাদ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু উদরাময়ের সময়ে ঘি খাওয়া কি বিষক্রিয়ার মত কাজ করে না ? হিংসা করা অন্যায়, ঠিকই। কিন্তু একটা কুকুর বা সাপ যদি আমাকে আক্রমণ ক'রতে আসে, তখন তাকে হিংসা দ্বারা প্রতিরোধ না ক'রলে আমার জীবনই বিপন্ন হ'য়ে প'ড়তে পারে। অতএব এখানে হিংসাটা ধর্ম্মেরই অঙ্গ। জল না হ'লে প্রাণ বাঁচে না, আবার সেই জলে ডুবেই মানুষ মরে। জীবনধারণের জন্য অর্থ চাই, আবার অর্থের অপব্যয়ে মহা অনাচারের সৃষ্টি হ'তে পারে। এইভাবে অজস্র উদাহরণ তুলে দেখানো যেতে পারে যে, ব্যবহার-বিজ্ঞান না জানার জন্য প্রবৃত্তির বশীভূত হ'য়ে আমরা ধর্ম্মের নামে অনেক অধর্ম্মাচার ক'রে চলি। ঠিকমত ধর্ম্মপালন ক'রতে হ'লে জাগতিক প্রতিটি বস্তু ও বিষয়ের ব্যবহার ও মাত্রানুপাতিক প্রয়োগবিধি ভালভাবে জানতে হবে।
আত্মরক্ষা ধর্ম্ম। আত্মরক্ষার জন্য প্রতিটি দেশকে ভীষণতম মারাত্মক অস্ত্রের নির্ম্মাণকৌশল ও বিনিয়োগপদ্ধতি জানতে হবে। সাথে-সাথে অপর দেশে প্রস্তুত ঐ-জাতীয় অস্ত্রের প্রতিষেধক যা'-যা' হ'তে পারে, সেগুলির গবেষণা ও নির্ম্মাণকার্য্যের দিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। আত্মরক্ষার্থে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মারণাস্ত্রের প্রয়োজন ঠিকই। কিন্তু শত্রুর প্রযুক্ত মারণাস্ত্রের শক্তি বিফল ক'রে দেবার মত বিজ্ঞান ও কৌশল যদি আমাদের হাতে না থাকে তবে আত্মরক্ষার কাজ সম্পূর্ণ হবে না, সত্তা সুরক্ষিত হবে না, অতএব ধর্ম্মপালনও হবে না। ধর্ম্ম যেমন জীবনের রক্ষণ ও পোষণ ক'রে থাকে, তেমনি ঐ রক্ষণ-পোষণের বিরোধী যা' অর্থাৎ জীবনবিনাশী যা' তাকেও ধ্বংস ক'রে থাকে। মৃত্যুকে প্রতিরোধ ক'রে জীবনকে উচ্ছল ক'রে তোলা ধর্ম্মের স্বভাবগতি। তাই, জীবনকে অর্থাৎ সত্তাকে সুধৃত ও জয়যুক্ত ক'রতে হ'লে মারণাস্ত্র নির্ম্মাণের সাথে-সাথে রাষ্ট্রকে মারণাস্ত্র-বিফলীকরণের প্রক্রিয়াও জানতে হবে। তবেই এক্ষেত্রে ঠিক-ঠিক ধর্ম্মপালন করা হবে।
আজকাল একটা কথা উঠেছে ----রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম্মকে জড়িত করা ঠিক নয়, রাষ্ট্র হবে ধর্ম্মের সম্বন্ধবর্জ্জিত। এই প্রস্তাবটা কতখানি ভ্রান্ত, তা' একটু আলোচনা ক'রলেই ধরা প'ড়বে। রাষ্ট্র তো মানুষকে নিয়েই গঠিত ! দেশের মানুষগুলি যাতে ভাল থাকে, সুখে থাকে, দেশের যাতে সবদিক দিয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়, এই সব-কিছু বিধান ঠিকমত করাই রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রের কাজ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এই কাজগুলির কোন্টা ধর্ম্মকাজ নয় ? ধর্ম্মও তো চায় ----প্রতিটি মানুষ সপারিপার্শ্বিক সুখে-সম্পদে বেঁচে থাকুক, দেশের পশুগণের শ্রীবৃদ্ধি হোক, সবাই উন্নতির দিকে ক্রমবর্দ্ধন-পরায়ণ হ'য়ে এগিয়ে চলুক। রাষ্ট্র চায় প্রতিটি মানুষেরই খাওয়া-পরার ব্যবস্থা ক'রতে, ধর্ম্মেরও চাহিদা তাই। রাষ্ট্র মানুষের আধিব্যাধি দূর ক'রে মানুষকে সুস্থ, সবল ক'রে তুলতে চায়, এও তো ধর্ম্মবিধি। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ----দেশকে পশু, অরণ্য, খনিজ প্রভৃতি সম্পদে সম্পন্ন ক'রে তোলা ; এ তো ধর্ম্মানুশীলনেরই অঙ্গ। তাহ'লে রাষ্ট্রের থেকে ধর্ম্মের বিচ্ছিন্ন হওয়া কি সম্ভব ? বোঝার ভুলে আমরা ব'লে থাকি ----ধর্ম্মপালনের সাথে রাজ্য-পরিচালনার কোন সম্বন্ধ নেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? রাজ্য-পরিচালকগণ কি জীবনরক্ষার্থে খান না, ঘুমান না, আনন্দ উপভোগ করেন না ? তা' যদি করেন, তবে তাঁরা ধর্ম্মই প্রতিপালন করেন। হ'তে পারে যে, সে-করার মধ্যে অনেক রকমফের আছে, অজ্ঞতার ফলে অনেক ভুল বা মিথ্যাচারও করা হ'য়ে থাকে। তবুও ঐসব করার যে উদ্দেশ্য, তা' হ'ল অস্তিত্বরক্ষা। আর, অস্তিত্বরক্ষার কাজ যা' তাই ধর্ম্ম। কণাদমুনির উক্তিতেও আছে----
'যতোহভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সঃসিদ্ধিঃ স ধর্ম্মঃ।'
(বৈশেষিকসূত্র, ১। ১। ২)
----যাতে অভ্যুদয় অর্থাৎ উন্নতি এবং পরম মঙ্গল সাধিত হয়, তাই ধর্ম্মঃ।
ধর্ম্মের রাজ্যে দুর্ব্বলতার কোন স্থান নেই। ধর্ম্ম মানুষকে ক'রে তোলে সাহসী, নির্ভীক, তেজস্বী, পরাক্রমশীল। ধর্ম্মনীতির বিহিত পরিপালনে অন্তরস্থ সুপ্ত সদ্বৃত্তিগুলির জাগরণ ঘটে। একটা মানুষের জীবন বিধৃত হয় অন্তরের ঐ সদ্গুণাবলীর দ্বারাই। ঐগুলিই তাকে ধ'রে রাখে, পরিবেশের সাথে তার মিলনসূত্র রচনা করে, তাকে জীবনবর্দ্ধনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। দয়া, মায়া, ভালবাসা, তেজ, সাহস, পরাক্রম, সাধুতা, উপচিকীর্ষা, সেবা প্রভৃতিই সেইসব সদ্গুণ। একটি সাধু লোকের যেমন এইসব গুণ আছে, তেমনি আছে একটি দুষ্ট লোকেরও ----যদিও সেটা সুষ্ঠুপথে নিয়ন্ত্রিত নয়। সুনিয়ন্ত্রিত হ'লে গুণগুলির শক্তি হ'য়ে ওঠে অসীম। প্রকৃত ধার্ম্মিকের জীবনের এইসব সদ্গুণ হ'য়ে ওঠে তার চরিত্রের উজ্জ্বল সম্পদ। গণিকা চিন্তামণির প্রতি বিল্বমঙ্গলের প্রেম ছিল অকৃত্রিম। সে-প্রেমেও তেজ, সাহস ও শক্তি ছিল, যার বলে ভয়ঙ্কর ঝড়ের রাতেও নদী পার হ'য়ে সাপের লেজ ধ'রে বিল্বমঙ্গল চিন্তামণির কাছে গিয়েছিলেন। কোন বাধাই তাঁকে তাঁর কাম্য প্রাপ্তির পথে আটকাতে পারেনি। কিন্তু এখানে ঐ গুণরাজির গতি নিম্নগামী। ঐ প্রেমই আবার যখন বিশ্বচিন্তামণি শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে সমর্পিত হ'ল, তখন তা' লম্পট বিল্বমঙ্গলকে ক'রে তুলল সাধক বিল্বমঙ্গল। বিল্বমঙ্গলের হৃদয়ের তেজস্বিতা, নির্ভীকতা, নিষ্ঠা নিখাদ ভগবৎপ্রেমের শিষ্ট ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর ও মহিমাময় হ'য়ে উঠল। পরস্ত্রীর পানে কামাতুর নয়নে তাকাবার শাস্তিস্বরূপ স্বীয় চক্ষু উৎপাটন করতে তাঁর হাত এতটুকুও কাঁপল না। ধর্ম্ম মানুষকে এতখানি সাহসী ও পরাক্রমী ক'রে তুলতে পারে।
Comments
Post a Comment