![]() |
Sri Sri Thakur about Country |
সাধারণ মানুষের অভ্যস্ত স্বাধীন কর্ম্মব্যবস্থার গতি এবং দিশা নির্ণয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অধিকারীগণদের প্রতি -
প্রথমে একটি কবিতা দিয়ে শুরু করি
দেবতার অশ্রু
ঐ মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন দেবতা
ফসলের দিকে চেয়ে হেমন্ত ঋতুর অপেক্ষায়,
ফসল পেকে উঠবে কৃষকের জমিতে,
কৃষক তার ফসলের অগ্রভাগ নিবেদন করবে তাঁকে
একটা সময় ছিল -
বিধাতার প্রবর্তিত এই যজ্ঞচ্চক্রের অনুবর্ত্তনে
কৃষক তার ইষ্টদেবতাকে জানাতো সংবর্দ্ধনা,
কৃষকের চঞ্চলচোখ হেমন্তের প্রতীক্ষায় দিন গুনতো -
কবে তার প্রথম ফসল পেকে উঠবে জমিতে
প্রিয় ইষ্টদেবতার চরনে নিবেদন করার জন্যে ?
সেই দিন কি চলে যাচ্ছে ?
যুগ কি এমনভাবে পরিবর্তনের পথে চলছে -
কৃষক কি ভুলে যাবে তার দেবতাকে
প্রথম ফসলটি দেবতার চরনে নিবেদন করতে ?
যা' সে প্রতিপালন করতো স্বাধীন আন্তরিক অর্ঘ্যে,
সৃষ্টির যজ্ঞচ্চক্রের এই উৎসব উপভোগের
এই সময়টাও কি আর তার হাতে থাকবেনা ?
আর যদি, তাই হয়ে থাকে -
তবে ঐ মহামূল্যবান রত্নের দ্বারা সজ্জিত মন্দিরে স্বর্ণপ্রতিমায় প্রতিষ্ঠিত ঐ দেবতার চোখের অশ্রু কি ঝরে পড়বে না ?
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
যদি এমন হয়ে থাকে, সনাতন ধর্ম্মের সকল রক্ষাকারীগণের প্রতি একটি আবেদন -
কৃষকের উৎপাদিত অন্নের উপর বিধাতার সনাতন বিধিব্যবস্থা নিয়ে
মানুষ নিজের মঙ্গলের জন্য মহামূল্যবান রত্নদ্বারা সজ্জিত করে দেবতার মন্দির নির্মাণ করে, প্রতিমায় দেবতার প্রতিষ্ঠা করে, কেউবা স্বর্ণালঙ্কারেও দেবতার বিগ্রহকে বিভূষিত করিয়া তুলেন । ব্যক্তিগত মন্দির হইলে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়ে কিংবা সংঘ-সংস্থার অধীনে পরিচালিত সার্ব্বজনীন মন্দির হইলে অর্ঘ্য আদায় করে বাজার থেকে পূজার সামগ্রী কিনে দেবতার চরনে নিত্যভোগ নিবেদন করা হয় ।
আমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানেননা - এইসকল নিত্য পূজার অতিরিক্ত দেবতাদের প্রতি প্রজাপতি ব্রহ্মার প্রবর্তিত আরেকটি যজ্ঞচ্চক্রের বিধান রহিয়াছে, যাহা কৃষকের উৎপাদিত অন্নের সাথে সম্পর্কিত । ( প্রমান - গীতার কর্ম্মযোগ অধ্যায়ের শ্লোকসংখ্যা ১০ - ১৬ )
শুধু তাদের প্রতি - যাহারা গীতায় শ্রদ্ধা করিয়া আছেন, গীতাকে বক্ষে ধরিয়া আছেন । যাহারা এই গীতাকে হাতে নিয়া ভগবানের বানীকে অবহেলা করিয়া থাকেন, তাহারা ভগবানকে অবজ্ঞাই করিয়া আছেন ; প্রকৃতপক্ষে তাহারা ছদ্মবেশী, কপটী, ভণ্ড ও প্রতারক ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ অধ্যায়ে বলিয়াছেন - এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত ।
- শ্লোকসংখ্যা ১২
আর তাই,
যিনি বা যাহারা গীতাকে শ্রদ্ধা সহকারে নিজের অন্তরে স্থান দিয়াছেন, গীতাকে বক্ষে ধারন করিয়াছেন, তিনি বা তাহারা ভগবানের এই সংবিধানের বিরুদ্ধে কোনো কর্ম্মব্যবস্থা গ্রহন করিতে পারেননা, আর এই কারণেই তাহারা কৃষকের উৎপাদিত অন্নকে নিজের অধিকারে নেওয়ার জন্য ততক্ষন পর্যন্ত অগ্রসর হইতে পারেননা বা অন্যকেও প্রোৎসাহিত করিয়া তুলার ব্যবস্থা দিতে পারেননা - যতক্ষন পর্যন্ত কৃষক উৎপাদিত ফসলের অগ্রভাগ তার প্রিয় উপাস্য ইষ্টদেবতার চরনে নিবেদন করিয়া সৃষ্টিরক্ষার এই যজ্ঞচ্চক্রের অনুবর্ত্তনক্রিয়া সমাপন করিয়া না উঠেন ।
সেই দিনটা যেন না আসে বন্ধু
হে কৃষক বন্ধু,
তুমি শুধু মানুষের জন্য অন্নউৎপাদক নও,
তুমি দেবতার জন্যও অন্ন উৎপাদন করে আসছ ;
যেদিন থেকে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন তোমাকে,
সেদিন থেকে তুমি শুরু করেছ তোমার এ কর্মযজ্ঞ ;
তুমি বিধাতার নির্দেশে পোষন দিয়ে আসছ সবাইকে -
ঐ মানুষ থেকে শুরু করে ঐ স্বর্গের দেবতা পর্যন্ত ।
তুমি তোমার ক্ষেতের ফসলের অগ্রভাগ
দেবতার চরনে নিবেদন করে আসছ আদিকাল থেকে,
এই করে তুমি অন্নের পবিত্রতা রক্ষা করে
পাড়াপড়শির সাথে নবান্ন উৎসব পালন করে
তারপর এই অন্নকে গ্রহন করছ দেবতার প্রসাদস্বরূপ ।
আজ তোমার প্রতি
একটা প্রশ্ন জাগলো মনে,
এমন দিন কি কখনও আসবে -
যেদিন তুমি অতিরোজগারের নেশায়
তোমার প্রিয় দেবতাকে ফাঁকি দিয়ে
জমিতে অন্নের বীজবপনের সাথে সাথে
বিক্রি করে দেবে তুমি আগামী দিনের ফসল ?
সেই দিনটা যেন না আসে,
সজাগ থেকো বন্ধু,
কেউ যেন তোমাকে কৃষ্টিচ্যুত করতে না পারে,
জন্ম হইতে তুমি স্বাধীনচেতনার অধিকারী,
কোনো প্রলোভন যেন তোমাকে কৃষ্টিচ্যুত না করে ।
তুমি তোমার মঙ্গলবিধাতাকে ফাঁকি দিওনা,
অতিরোজগারের নেশায় এই যজ্ঞচ্চক্রকে ভুলিওনা ।
বিধাতার এই যজ্ঞবিধান সনাতন,
কোনো পুরুষের সাধ্য নাই বিধাতার এই সংবিধানে
বিকল্প বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন করে দিতে ।
যেমন করে মেনে আসছ পরম্পরাগতভাবে,
তেমনি করে পালন করে চল বন্ধু এই বিধিব্যবস্থা ;
নতুন কোনো ব্যবস্থার আমদানি করতে যেওনা ।
সেইদিনটা যেন না আসে বন্ধু,
যাতে দেবতারা বঞ্চিত হয়ে পড়েন
তোমার ক্ষেতের অন্নের প্রাপ্য অগ্রভাগ থেকে ;
এই নিবেদন রাখি তোমার কাছে,
ভুলে যেওনা তুমি এই কৃষ্টি-বৈভব -
বিধাতার আশীর্বাদ - সৃষ্টিরক্ষার এই যজ্ঞচ্চক্র ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার কর্ম্মযোগ অধ্যায়ে শ্লোক সংখ্যা ৩৫-এ বলিয়াছেন - স্বধর্ম্ম কিঞ্চিৎ দোষবিশিষ্ট হইলেও উহা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বধর্ম্মে নিধনও কল্যাণকর ; কিন্তু পরধর্ম্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক ।
আবার শ্রীশ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলিয়াছেন -
পূর্বঋষি পিতৃকৃষ্টি
অস্বীকারে ধরবি যা',
পাতিত্য তোর আসবে ওরে
নষ্ট হবে জাতীয়তা ।
- অনুশ্রুতি গ্রন্থ, প্রথম খণ্ড, রাষ্ট্র ধর্ম্ম অধ্যায় হইতে
এখানে স্বধর্ম্ম মতলব পূর্বঋষিদের প্রবর্তিত যেসকল শাস্ত্রীয় বিধিবিধান পরম্পরাগতভাবে একজন লোক মানিয়া আসিতেছেন । তাহা পরিত্যাগ করিয়া অন্যদের দ্বারা প্রবর্তিত কোনো নিয়মকে গ্রহণ করতে নেই যদিও অন্যের দ্বারা প্রবর্তিত ঐ মত অধিকতর মঙ্গলকারী বলিয়া প্রতীত হয়েও থাকে ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই যজ্ঞচ্চক্রের উপর শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যাহা বলিয়াছেন কর্মযোগ অধ্যায়ে, নীচে শুধু তাহার বাংলা অনুবাদটুকু দেওয়া হইলো - শ্লোকসংখ্যা ১০ থেকে ১৬ ।
সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি যজ্ঞের সহিত প্রজা সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছেন - তোমরা এই যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হও ; এই যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্টপ্রদ হউক । ১০
এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবগণকে ( ঘৃতাহুতি প্রদানে ) সংবর্দ্ধনা কর ; সেই দেবগণও ( বৃষ্ট্যাদি দ্বারা ) তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুন ; এইরূপে পরস্পরকে সংবর্দ্ধনাদ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে । ১১
যেহেতু, দেবগণ যজ্ঞাদিদ্বারা সংবর্দ্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন, সুতরাং তাঁহাদিগের প্রদত্ত অন্নপানাদি যজ্ঞাদিদ্বারা তাহাদিগকে প্রদান না করিয়া যে ভোগ করে সে নিশ্চয়ই চোর ( দেবস্বাপহারী ) । ১২
যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশেষ অন্নভোজন করেন অর্থাৎ দেবতা, অতিথি প্রভৃতিকে অন্নাদি প্রদান করিয়া অবশিষ্ট ভোজন করেন, তাহারা সর্ব্ব পাপ হইতে মুক্ত হন । যে পাপাত্মারা কেবল উদর পূরণার্থ অন্ন পাক করে, তাহারা পাপরাশিই ভোজন করে । ১৩
প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হইতে মেঘ জন্মে, কর্ম্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত ; সেই হেতু সর্ব্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন । যে এইরূপে প্রবর্তিত যজ্ঞচ্চক্রের অনুবর্ত্তন না করে ( অর্থাৎ যজ্ঞাদি কর্ম্মদ্বারা এই সংসারচক্র পরিচালনার সহায়তা না করে ), সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবন ; হে পার্থ, সে বৃথা জীবন ধারণ করে । ১৪ - ১৬
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
যদি এমন হয়ে থাকে - সংখ্যাতন্ত্রের দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত কর্ম্মনিয়ন্ত্রনকারী অধিকারীগণের ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে -
যদি হাজারের মধ্যে ৯৯৯ জন ব্যক্তিও এক মত হয়ে যান এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপর এমন কোনো নিয়ম তৈরি করে দেন - যাতে ঐ একজন উদ্বিগ্ন বা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উঠেন, তখন সেই একজন কি করিবেন ? তিনি নিরুপায় হয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া নীরবে নিভৃতে অন্তরের বেদনায় শূণ্যে ঈশ্বরের প্রতি তাকিয়ে উদাস নীরবতায় নিজেকে শান্ত্বনা জানিয়ে এতটুকুই বলবেন, "প্রভু, ইহা কি জন্মান্তরের কর্ম্মফল ?"
যদি এইরকমই সংখ্যাতন্ত্রের ক্ষমতা হয়ে থাকে যে সমর্থনের সংখ্যাদ্বারা যা' কিছু করা যায় এবং এইরকম ক্ষমতার ব্যবহারে যদি কাহারো জীবন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে আর সার্বভৌম ক্ষমতায় ইহার কোনো প্রতিরোধী ব্যবস্থা কাহারো হাতে না থাকে, তাহলে ইহার প্রতিরোধ বা প্রতিকারের একমাত্র ক্ষমতা শেষ বিচারক ঈশ্বরেরই হাতে ।
আর এইরকম যখন ঘটে উঠার সম্ভাবনা যাদের হাতে দেখা দেয়, তাদের প্রতি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে ঐ সাধারণ মানুষের স্বাধীন জীবনযাত্রার পথে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়ে উঠে - আর তাহাই সমাজের সার্বিক স্বাধীনতায় মঙ্গলসাধনার একমাত্র উপায় । শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুলচন্দ্র বলেছেন -
"অবাধে ভালো করতে পারাই
স্বাধীনতা কয়,
উচ্ছৃঙ্খলের প্রশ্রয় পাওয়া
স্বরাজ কিন্তু নয় ।"
"যা ইচ্ছা তাই করবে তুমি
তা কিন্তু রে চলবে না,
ভালো ছাড়া মন্দ করলে
পরিস্থিতি ছাড়বে না ।"
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
"আমি যে দেখেছি--- প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।"
সমাজের হিসাবের খাতার বাহিরে একপ্রকার দুর্বল শ্রেনীর লোক চিরদিনই নীরবে নিভৃতে মনের দুঃখে এক উদাসীন শান্তিপ্রিয়তায় জীবন কাটাইতে বাধ্য হয়ে আছেন - এই অচিহ্নিত অবহেলিত এইসব দুর্বলেরা জাতি-ধর্ম, বর্ণ-পেশা, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, শিশু-বৃদ্ধ, উঁচু-নীচু নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেনীর মধ্যেই রয়েছেন । এই দুর্বলেরা কখনও শ্রেনী বিভাজনের আওতায় ধরা পড়েনা । আর তাই ইহাদের কোনো union নেই, আর তাই তথাকথিত সাংগঠনিক কোনো নেতাও নেই, আর থাকলেই বা কি হবে ? কে কার কথা শোনে এই গলাবাজির যুগে ?একমাত্র ঐ বিশ্ববিধাতা পুরুষোত্তমই ইহাদের জীবননেতা ।
এইসব পীড়িতদের পরিচয়ে একটা উদাহরণ -
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে জড়িত প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী এবং সবজির বাজার থেকে
বাজার শুধু উৎপাদকের সুবিধার জন্যই নয় ; বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয় পক্ষের সুবিধাজনক সম্পর্ক স্থাপন যেখানে সহজ হয়ে উঠে, সেখানেই বাজার গড়ে উঠে । যেখানে তুলনামূলক কম খরচে ক্রেতা ও বিক্রেতা পৌঁছতে পারে, সেই জায়গাই ইহার উপযুক্ত স্থান ।
বাজারে সমাজের অসহায়, আঁতুর, নেংড়া, দরিদ্র, প্রবীণ, দুর্বলশ্রেনীর লোকেরাও যায়, তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব্জী খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করার জন্য অথবা বিক্রয় করার জন্য । পরিস্থিতির কারণে তাদেরকে সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না । শুধু তারাই নহে, অনেক গরীব অসহায় পরিবারের মেয়েছেলে বাচ্চারাদেরকেও পায়ে হেঁটেই বাজার করতে হয় ।
যদি বাজারকে স্থানান্তিকরনের অন্যকোনো অনিবার্য কারণ না থাকে এবং মানুষের ঐসকল পরিস্থিতি বা অবস্থাকে অবহেলা করে বাজারকে দূরে স্থানান্তরিত করা হয়, তবে সমাজের দুর্বল শ্রেনীভুক্ত জনসাধারণের অসুবিধার সৃষ্টি হবে যদিও এই বাজারটি হাই-ফাই কাঠামোয় নির্মিত হয়ে থাকে ।
আর তাই, মানুষের সকল প্রকার সুবিধাঅসুবিধায় স্বাভাবিকভাবে যেখানে এই সকল বাজার গড়ে উঠেছে, তাহার স্থানান্তিকরনে সর্বাগ্রে দেখিতে হইবে এইসকল দুর্বলশ্রেনীর মানুষদের জীবনে কোনোপ্রকারের অসুবিধা সৃষ্টি হইতেছে কি না ।
যদি এইপ্রকার কোনো বাস্তবায়ন দুর্বলশ্রেনীর মানুষদের জীবনের কষ্টের কারণ হয়ে থাকে, তবে ইহা মানুষের সার্বিক মঙ্গলের দাবিদার কেমন করে হতে পারে ?
ওদের অন্তরের নীরব বেদনা -
আমরা তুচ্ছ হলেও আমাদের ভুলে যাবেন না যদিও আমরা হাজারের মধ্যে একজনও হইনা কেন । আমরা এই পৃথিবীতে বাকী জীবন শান্তিতে বাস করা ছাড়া আর কিছুই চাই না। উন্নয়নের নামে আমাদের জীবনযাত্রার উপলভ্য সুবিধাটুকু হরণ করে নিবেননা । আমরা এতটাই গরিব যে আমরা পায়ে হাঁটা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই, আমরা এতটাই দুর্বল যে আমরা পায়ে বেশিদূর হাঁটতে পারিনা । সুতরাং, আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও সবজীর বাজারটি এমন দূরত্বে নিয়ে যাবেন না যেখানে আমরা পৌঁছিতে পারিনা ।
এই পীড়িতেরা ভগবানে বিশ্বাস রেখে ভগবানের চরনে উদাসীন শান্তিপ্রিয়তায় নিজেকে শান্ত রাখিতে বাধ্য থাকিবেন, "সবই তোমার ইচ্ছা প্রভু ।" হয়তো বা ভগবানের শ্রীচরনে আন্তরিক আবেদনে কবিগুরুর সেই কবিতাটিও স্মরণ করিতে থাকিবেন -
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি--- প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রনায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে॥
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃসপ্নের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে---
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এ ছাড়া তার দুঃখ নিরসনের আর অন্য কোনো উপায় নাই । তাই, সেই অসুবিধাকে সহ্য করিয়াও জীবন নির্বাহ করিতে বাধ্য থাকিবেন । চোখের সামনে সোনার থালাস্বরূপ প্রগতির কাঠামোকে দর্শন করিয়া মুগ্ধ-মোহিত নেত্রে পারিপার্শ্বিকের সাথে সেই নির্মাতার প্রতি প্রশংসা ও গৌরববোধের শুধু বাচনিক স্তাবক হইয়া থাকিবেন ।
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
মনে রাখবেন অজ্ঞানকৃত কর্ম্মফলও কাহারো পিছা ছাড়েনা । কেহ যদি জন-কল্যাণের জন্য যা-কিছুই করতে যান, সকল কাজের প্রথমেই ঐ রোগ্ন, অসহায়, দুর্বল, , চলৎশক্তিহীন গরীব শিশু-বৃদ্ধ-মেয়েছেলেদের পায়ের অবস্থা সর্বদা স্মরণে রেখে তা' করতে হবে । কেহ যদি মহাতপস্বী ঋষি বিশ্বামিত্রের ন্যায় নতুন স্বর্গও বানিয়ে ফেলেন, আর ঐ কর্মযোজনায় সহায়সম্বলহীন নগন্যদের অভ্যস্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সুবিধাগুলোর সাথে conflict তৈরি করিয়া ঐ স্বর্গপুরীতে পৌঁছানো একান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং সেই চলাটা যদি তাদের জন্য পায়ে চাবুকের আঘাতের মতো হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই ঈশ্বরের দরবারে তাহাকে একদিন অপরাধী হইয়া উঠিতে হইবে - কাল অনন্ত, এর শেষ নেই ।
মহামতি ভীষ্মকেও ত্রিশ জন্মের পূর্বের এক অজ্ঞানকৃত কর্ম্মফলের জন্য কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে শরসয্যায় তীব্র বেদনা ভোগ করিতে হইয়াছে, নিয়তির বিধানে মহাকালের হাত থেকে কাহারো রক্ষা নেই । যিনি যা' যা' করে থাকেন, নিয়তি তার কৃতকর্ম্মের উপহার যথাসময়ে ফিরিয়ে দেয়, প্রত্যাহার করার কোনো উপায় নেই ।
মহাকালের বুকে যদিও ভগবান শেষ বিচারক, তথাপি সমাজের ন্যায় ও ধর্ম্মের রক্ষাকারী শক্তিমান ব্যক্তিগণ নিপীড়িতদের পাশে এসে কেন দাঁড়ান ?
উত্তর -
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিকারহীন এই সব নিপীড়নের দৃশ্য দেখে সর্বশক্তিমান ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন -
"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ।"
আর বর্তমান যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের শ্রীমুখ হইতে বেরিয়ে এলো,
"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
বিধাতার রুদ্ররোষ তারে তৃণসম দহে ।"
আর তাই, যাহারা সক্ষম সবল যাহাদের হাতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে, তাহারা যদি দুর্বলদের উপর সবলের নিপীড়নের প্রতিবাদ না করেন, তবে বিধাতার দরবারে তাহারাও অন্যায়কারীর ন্যায় দোষী সাব্যস্ত হইয়া উঠিবেন অন্যায়কে সহন করে নেওয়ার অপরাধে, তাদের উপরেও বর্ষিত হয়ে উঠবে বিধাতার রুদ্ররোষ ।
আর এই কারণেই দুর্বলদেরকে সকল প্রকার নিপীড়ন থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই সমাজের ন্যায় ও ধর্ম্মের রক্ষাকারী শক্তিমান সজ্জন সুধীগণ সর্বদা এগিয়ে আসেন ।
xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
সমাজের সার্বিক জন-কল্যাণের সাধনায় যাহারা আত্মসমর্পিত, তাদের প্রতি -
মানুষের জীবনযাত্রার অভ্যস্ত কর্মপ্রনালী ও সুবিধার সাধারণ স্বাধীনতা রক্ষায় গীতার উপদেশবানী ও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
আজ মানুষ কেন এতো অশান্ত ? মানুষ কেন এতো উদ্বিগ্ন ? কার কথা কে শুনবে ? কে কাহাকে কি বুঝাবে ? প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের নিজের প্রকৃতি অনুসারে কর্ম করিয়া থাকেন ।
নতুন কোনো জন-কল্যাণমূলক কর্মযোজনায় কোনো বিশেষ জনসমষ্টির স্বার্থের প্রাধান্য দিতে গিয়ে খেয়াল রাখা অতিআবশ্যক - যেন ভুলেও অন্য কোনো একজনও সাধারণ লোকের অভ্যস্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে না, কোনো প্রকারের বিড়ম্বনা কিংবা উদ্বিগ্নতারও সৃষ্টি না করে ।
মনে হয় ভগবানও কাহারো অভ্যস্ত স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাত্রার কর্মপ্রনালীতে হস্তক্ষেপ করেন না, কারন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলিয়াছেন -
যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ ।
হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্ম্মুক্ত যঃ স চ মে প্রিয়ঃ ।।
- ভক্তিযোগ অধ্যায়, শ্লোক সংখ্যা ১৫
যার বাংলা অনুবাদ -
"যাঁহা হইতে কোন প্রাণী উদ্বেগপ্রাপ্ত হয় না, এবং যিনি স্বয়ংও কোন প্রাণীকর্তৃক উত্যক্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয় ।"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আরও বলিয়াছেন -
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্ ।
যোজয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ ।।
- কর্মযোগ, শ্লোক সংখ্যা ২৬ ।
উক্ত বানীর অনুবাদ -
জ্ঞানীরা কর্ম্মে আসক্ত অজ্ঞানীদের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না । আপনারা অবহিত হইয়া সকল কর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া তাহাদিগকে কর্ম্মে নিযুক্ত করিবেন ।
এই শ্লোকের মর্মানুসারেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে পরিষ্কার বলিয়াছেন সাধারণ মানুষের অভ্যস্থ কর্মপ্রনালীর বুদ্ধিতে কেহ ভেদ সৃষ্টি করিয়া বিভ্রান্তি ঘটাইয়া তাহাদেরকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিবেন না ।
সুতরাং যাহারা যেমনভাবে চলিতেছেন, তাহাদের এই অভ্যস্ত জীবনযাত্রার উপর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় । অতিরিক্ত বুঝানোর জন্য জবরদস্তি প্রয়াস করাও ঠিক নয় । বিনা বাধায় মানুষের ভালো করতে হয় ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় কর্মনিয়ন্ত্রণকারী জ্ঞানীদের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এইই নির্দেশ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও বলেছেন
"অবাধে ভালো করতে পারে
সেই তো স্বাধীন,
উচ্ছৃঙ্খলায় মরন আনে
তাই তো পরাধীন ।"
( শ্লোকসংখ্যা - ২৭ )
Comments
Post a Comment