Skip to main content

দয়াল ঠাকুর - দ্বিতীয় পর্ব

Sri Sri Thakur Anukulchandra
*                        'দয়াল ঠাকুর - (২)'
                                দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

       ইং ১৯৬৪ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর এই দীন সেবককে, ইষ্টভৃতির মূল তত্ত্ব বিশ্লেষণ ক'রে একখানা বই লিখতে আদেশ করেন। আদেশ পওয়ার মুহূর্ত্ত থেকেই আমি সমগ্র বিষয়টাকে মাথায় সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, ভাবছি সুরুটা কিভাবে হবে, কোন্ কোন্ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে, ইত্যাদি। ভয়-ভয়ও করছে এই ভেবে যে আমার মতন ক্ষুদ্র ব্যক্তি কি ক'রে পুরুষোত্তম-প্রবর্ত্তিত এত বড় তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করবে ! তবুও ঠাকুরের আদেশ, করতেই হবে। এইভাবে চিন্তা করতে করতে রাত কেটে গেল।


       পরদিন সকালে তাঁর সন্মুখে যেয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন, "তোর লেখা হ'য়ে গেছে ?" আমি শুনে তো হাঁ। এত বড় কাজটির কথা বললেন মাত্র গতকাল। আর আজ সকালেই খবর নিচ্ছেন হ'য়ে গেছে কিনা। মাথা নেড়ে বললাম, 'আজ্ঞে না'। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "তাড়াতাড়ি ক'রে ফেলা।"
       সেইদিনই লেখা সুরু করলাম বটে। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম, ব্যাপার বিরাট। যাহোক, বইপত্র কিছু ঘাঁটাঘাঁটি ক'রে নিয়ে কাজ সুরু ক'রে দিলাম। কয়েক পাতা লেখা হ'য়েও গেল। পরদিন সকাল, তখন কেবল প্রাতঃপ্রণাম শেষ হয়েছে, শ্রীশ্রীঠাকুরের আবার একই প্রশ্ন "হয়েছে ?" আমার যথারীতি উত্তর 'না'। আশ্রমবাসিগণ ছাড়াও বহিরাগত অনেক দাদা ও মা উপস্থিত। ঘটনার পশ্চাৎপট যারা জানে না তাদের মনে এমন ধারণা হওয়া অসম্ভব নয় যে---- এই ছেলেটিকে ঠাকুর কিছু কাজ করতে আদেশ করেছেন এবং রোজ জিজ্ঞাসা করছেন কাজটি করেছে কি না, কিন্তু ছেলেটি কিছুতেই তা করছে না, ঠাকুরের আদেশ অমান্য করছে।
       এইভাবে পর-পর তিনদিন খোঁজ নেওয়াতে আমার কাজের গতি আপনা থেকেই বেড়ে গেল। সমগ্র বিষয় ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি যেন এক-এক করে চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। শ্রীশ্রীঠাকুরের কথার সমর্থনে উপযুক্ত শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতিগুলিও বই হাতড়ে তাড়াতাড়িই পেয়ে যেতে লাগলাম।
       মাত্র বারো দিনের মধ্যেই লেখাটি সম্পূর্ণ হ'ল। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে যেয়ে নিবেদন করতে প্রীত হলেন তিনি। এই পুস্তকটির নামও তিনি কৃপা ক'রে দিলেন 'ইষ্টভৃতি-মহাযজ্ঞ'।
       শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ ছিল, যে-কাজই হোক তা' দ্রুত অথচ নিখুঁতভাবে সুসম্পন্ন করা। কারণ, এমন করার ভিতর দিয়ে চরিত্রের ঢিলেমি দূর হয়, চরিত্র সংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়, 'মোটর' ও 'সেন্‌সরি' নার্ভের সুসমন্বয় ঘটে, মস্তিষ্কশক্তিও বৃদ্ধি পায়। কর্ম্মে শিথিলতা বা ঢিলেমি, এই চরিত্রই হ'ল মানুষের দুঃখের কারণ। মানুষ যাতে ঐ দুর্ব্বলতা এড়িয়ে সাচ্চা মানুষ হ'তে পারে তারই জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর মাঝে মাঝে এমনতর চাপের মধ্যে মানুষকে রাখতেন।
       পরমপিতা পরম দয়াল। তাঁর সৃষ্টি রক্ষা করতে তিনি সদাই তৎপর। তাই, তাঁর দয়া নিরন্তর ঝরে চলেছে প্রতিপ্রত্যেকের উপরে। যে যেমন কুড়িয়ে নিতে পারে আর কি ! যেমন, সূর্য্যের আলো সবার জন্যই ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। যদি কেউ ঘরের কোনে ব'সে থাকে, তার গায়ে তো আর আলো পড়বে না। আলো পেতে হ'লে তাকে বাইরে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াতে হবে। সেইজন্য শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, "দয়ার বাতাস তো বইছেই, তুমি পাল তুলে দাও।" এই পাল তোলার দায়িত্বটা র'য়ে গেছে প্রতিটি ব্যক্তির। ঐ চেষ্টাটুকু তাকে করতে হবে। না করলে দয়া থাকলেও তা' পাওয়া হবে না। এ ব্যাপার শ্রীশ্রীঠাকুর-সন্নিধানে নিয়ত ঘটতে দেখেছি। এমনতর কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি-----
       রেলবিভাগে কাজ করত আসানশোলের এক সৎসঙ্গী, নাম তার হরিসাধন। অন্যান্য সৎসঙ্গীদের মতন সে-ও মাঝে-মাঝে ঠাকুরবাড়ী আসে। তবে তার চেহারা ও বেশভূষা ছিল অপরিচ্ছন্ন, সর্ব্বাঙ্গে কেমন একটা বিষন্ন দরিদ্রতার ছাপ। কারো সাথে বিশেষ কথা বলত না। এসে ঠাকুর-প্রণাম ক'রে দু'এক বেলা আশ্রমে কাটিয়ে ফিরে যেত।
       শ্রীশ্রীঠাকুর তখন পার্লারগৃহে অবস্থান করছেন। একদিন হরিসাধন এসে তাঁকে বলল, 'বাবা ! আমি প্রায়ই দেখি, মা-কালী যেন আমাকে তাড়া ক'রে আসছে।' শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "এক কাম করিস্। প্রত্যেক মাসে আমার জন্য ঝুড়িভর্ত্তি তরকারী নিয়ে আসবি।" হরিসাধন, 'আচ্ছা' ব'লে প্রণাম ক'রে চ'লে গেল।
       তারপর থেকে হরিসাধন প্রতিমাসে ঝুড়িভর্ত্তি নানারকম আনাজপাতি মাথায় ক'রে নিয়ে আসে। শ্রীশ্রীঠাকুর এসব শ্রীশ্রীবড়মার কাছে দিয়ে আসতে বলেন। দুইবার এরকম আনার পরে শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে হঠাৎই জিজ্ঞাসা করলেন, "আর কালী দেখিস্ ?" একগাল হেসে হরিসাধন উত্তর করল, 'আজ্ঞে না।' শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "প্রতিমাসে আমাকে এইরকম করে তরকারী খাওয়াবি।"
       তারপর থেকে হরিসাধন এই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে ক'রে চলেছে। কোন মাসেই এর ব্যতিক্রম হয়নি। আর, এই আদেশ অস্খলিতভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে হরিসাধনের চেহারায় এসেছে জলুষ, বেশভূষায় এসেছে পারিপাট্য, সর্ব্বোপরি তার সাংসারিক পরিস্থিতও উন্নত হয়েছে।
       শ্রীশ কর নামে জনৈক সৎসঙ্গী একদিন এসে করজোড়ে কাতরকন্ঠে শ্রীশ্রীঠাকুরকে বললেন, 'ঠাকুর, আমার স্ত্রীর সন্তান হ'য়ে বাঁচে না।' পিতৃহৃদয়ের এই ব্যথাতুর আকুলতা বুঝি স্পর্শ করল দয়াল পুরুষের রক্ষণী-সম্বেগকে। সস্নেহে তিনি তাকে বললেন, "তুই রোজ নীল জবা দিয়ে সূর্য্যপূজা করিস্।" শুনে শ্রীশদা প্রণাম ক'রে চ'লে গেলেন।
       তারপর নীল জবা খুঁজে বের ক'রে তিনি তাই দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত সূর্য্যপূজা করতে থাকেন। একে-একে তিনি তিনটি ছেলের পিতা হলেন। তিনটি ছেলেই সুস্থ দেহে বেঁচে আছে।
       একবার একটি মা এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে বলেন যে তাঁর পর-পর তিনটি মেয়ে হয়েছে, এখন একটি ছেলে পাওয়ার বড় সাধ। শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে বললেন, "এক গেলাস জলে একটা করে লেবুর সম্পূর্ণ রস মিশিয়ে রোজ খাবি।" অদ্ভুদ চিকিৎসা-ব্যবস্থা ! যুক্তি দিয়ে বোঝে সাধ্য কার ? ঐ ব্যবস্থা-অনুযায়ী চলার ফলে মা-টির একটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলে হয়।
       এইরকম বহু ঘটনা ঘটেছে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে। এসবের কারণ বিশ্লেষণ করতে যেয়ে অন্ধের হস্তী দর্শনের মতন ব্যাপার ঘটাব না। কেবল স্থূল চর্ম্মচক্ষে যেটুকু ধরা পড়েছে তাইই উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করছি।
       কর্ম্মসূত্রে ব্রহ্মদেশের রেঙ্গুনে থাকতেন মধুসূদন মুখার্জী। তিনি স্থানীয় একটি ক্যারেন মেয়েকে ভালবেসে বিবাহ করেছিলেন। কালক্রমে তাঁদের দুটি সন্তানও হয়। কিন্তু বিধিসন্মতভাবে বিবাহ না হওয়ার দরুন তাঁদের দাম্পত্য-জীবন সুখের ছিল না। পরস্পরের মধ্যে বনিবনার অভাব ছিল। ফলে, কলহ ও অসহযোগ লেগেই থাকত।
       এঁদের প্রতিবেশী ছিলেন জনৈক সৎসঙ্গী। তিনি কিছুদিন যাবৎ ব্যাপারটা লক্ষ্য ক'রে ওদের কাছে যান, যাজন করতে থাকেন এবং একবার দেওঘরে গিয়ে পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে দর্শন ক'রে আসার কথা বলেন। দাদাটি ভেবেছিলেন, ঠাকুরের কাছে গেলে তাঁর আশীর্ব্বাদে যদি ওদের মানসিকতার পরিবর্ত্তন হয়, তাহ'লে ওরা বেঁচে যাবে, ওদের জীবনে শান্তি আসবে। শ্রীশ্রীঠাকুরের মহিমার কথা শুনে মধুসূদনদা সপরিবারে ঠাকুরবাড়ী আসতে রাজী হন।
       আশ্রমে আসার পরে প্রতিবেশী দাদাটি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে মধুসূদনদার জীবনের সব কথা নিবেদন করলেন। সব শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর ওদের যত-আশ্রমের ননীগোপাল চক্রবর্ত্তীদার সাথে আলাপ করতে বললেন। ননীদার সাথে কথা ব'লে মধুদা তৃপ্ত হলেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুমতি নিয়ে সস্ত্রীক ননীদার মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
       দীক্ষার পরে ননীদাও মধুদার পারিবারিক অশান্তির কথা কিছু কিছু শ্রীশ্রীঠাকুরকে বললেন। উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "ওকে সহপ্রতিঋত্বিকের পাঞ্জা দিয়ে দে, আর ভালভাবে কাজকাম করতে ব'লে দিস্।"
       একেবারে নতুন যার দীক্ষা হ'ল, মাত্র এক সপ্তাহ পরেই তাকে সহপ্রতিঋত্বিকের পাঞ্জা দেওয়া হ'চ্ছে। নিয়মের বিশেষ ব্যতিক্রম। তবে এক্ষেত্রে নিয়মের যিনি স্রষ্টা, নবতম ব্যবস্থাটিও যে তাঁরই। যাহোক, শ্রীশ্রীঠাকুরের আদেশে ননীদা মধুদাকে স্বস্ত্যয়নী দিয়ে পাঞ্জা দেবার ব্যবস্থা ক'রে দিলেন।
       পাঞ্জার দায়িত্ব পাওয়ার পর মধুদার মন অনেক স্থির হ'ল, মনে হ'ল বুঝি বা আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মধুদার স্ত্রী ক্যারেন মেয়ে হ'লেও বাংলা একটু-একটু বোঝেন। সবার সাথে কথাবার্ত্তা ব'লে তাঁর মনটাও বেশ হাসিখুশি। কোন্ মানুষের জন্য কেমন প্রেস্‌ক্রিপ্‌সন্ দরকার, কাকে কোন্ বৈশিষ্ট্যের পরিপোষণ দিয়ে সুস্থ-স্বস্থ ক'রে তোলা যাবে, তা' জানেন একমাত্র ভবরোগ-বিশেষজ্ঞ যিনি।
       কয়েকদিন আশ্রমে থাকার ফলে বোধ হয় মধুদার পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। ওঁদের রওনা হবার দিনও এসে গেল। শ্রীশ্রীঠাকুর মধুদাকে মন দিয়ে যাজনকাজ করার কথা পুনঃপুনঃ ব'লে দিলেন। ভক্তিভরে প্রণাম ক'রে ওঁরা শিশুসন্তান দুটি সহ রওনা হ'য়ে গেলেন।
       রেঙ্গুনে ফিরে যাবার পর মধুদার দু'তিনখানা চিঠি ননীদার কাছে আসে। তাতে জানিয়েছেন, উনি নামধ্যান করছেন, যাজন করছেন, কয়েকজন দীক্ষাও হয়েছে, ইত্যাদি। তারপর মধুদা আর কোন যোগাযোগ রাখেননি। শ্রীশ্রীঠাকুর মাঝে মাঝেই ননীদার কাছে মধুদার কথা জিজ্ঞাসা করেন। ননীদা কোন খবরই দিতে পারেন না।
       ছয়মাস পরে রেঙ্গুনের একজন সৎসঙ্গী চিঠি লিখলেন---- 'রেঙ্গুনের উপকূলে সমুদ্রের জলে মধুদার মৃতদেহ ভেসে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাঁর পত্নী ও সন্তানদের কোন খবর নেই।' শ্রীশ্রীঠাকুর সব শুনলেন। চোখমুখ তাঁর বিষাদাচ্ছন্ন হ'য়ে পড়ল। সংক্ষেপে শুধু বললেন, "পাঞ্জা দিয়েও বাঁচানো গেল না।"
       শ্রীশ্রীঠাকুর পাঞ্জা দিয়ে আশীর্ব্বাদ করেছিলেন। পাঞ্জার দায়িত্ব ঠিকমত বহন করে যদি মধুদা চলতেন, যজন-যাজন-ইষ্টভৃতির সাথে লোকচর্য্যাকে যদি জীবনের ব্রত করে নিতেন, তাহলে দাম্পত্য কলহ এড়ানো এবং এই অকালমৃত্যুর কারণ থেকে রক্ষা পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হ'ত। জন্মান্তরের কোন সুকৃতির বশেই সে এত বড় আশীর্ব্বাদ লাভ করল, বাঁচার পথ পেল। তার এজন্মের কোন ভুল ও প্রবৃত্তিপ্রীতি এতই প্রবল ছিল যে অটুট নিষ্ঠায় ইষ্টকর্ম্ম নিয়ে লেগে থাকা ছাড়া ঐ ভয়াবহ পরিণতি থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোন উপায় ছিল না। দয়া ঠাকুর করেছিলেন, বাঁচার সুযোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ পাল খাটাবার ব্যাপারটা তার ঠিকমত হ'ল না। ফলে, প'ড়ে গেল নিয়তির কবলে।
       শান্ত আশ্রম পরিবেশ। প্রিয়পরমের কাছে ব'সে ভক্তগণ উপভোগ করছেন তাঁর সঙ্গসুখ। নানা বিষয়ে কথা চলছে। এই সময় একটি মেয়ে এসে প্রণাম করল। কপালে সিন্দুর এবং হাতে শাঁখা দেখে বোঝা যায় ময়েটি বিবাহিতা। সাথে তার আর কেউ নেই। কেমন একটু উদ্‌ভ্রান্তের মতন দেখাচ্ছে তাকে।
       প্রণাম ক'রেই মেয়েটি বলতে আরম্ভ করে---- 'ঠাকুর ! আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে রাগারাগি ক'রে এসেছি। ওখানে আর ফিরে যাব না। আমি আপনার কাছে থাকব।'
       শ্রীশ্রীঠাকুর---- "কেন, কী হয়েছে ?"
       মেয়েটি---- 'ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওদের ব্যবহার খুব খারাপ।'
       শ্রীশ্রীঠাকুর---- "তা' থাক্ এখন।"
       এবার মেয়েটির চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। বলছে---- 'ঠাকুর ! শ্বশুরবাড়িতে আমি আর যাব না। ঐ বিয়েই আমার স্বীকার করতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করছে শাঁখা ভেঙ্গে ফেলি, সিন্দুর মুছে ফেলি।'
       শ্রীশ্রীঠাকুর---- "তোর যদি ভাল লাগে তাই করিস্।"
       আমরা যারা শুনছি এই সব কথা, তারা বিস্মিত। এ কেমন হচ্ছে ? ঠাকুর চান, মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর ঘর করুক, শ্বশুরকুলে সম্রাজ্ঞী হ'য়ে উঠুক। কিন্তু এ তো দেখছি তার উল্‌টা ব্যাপার। মেয়েটি বিয়েই অস্বীকার করতে চাইছে এবং ঠাকুর তার সমর্থন করছেন। এর কারণ না জানলেও এটুকুু বুঝলাম যে পিছনে কোন গূঢ় রহস্য আছে। নতুবা, তাঁর নীতির অন্যথা তিনি করবেন কেন ?
       যাহোক, আপাততঃ ব্যাপারটা এই পর্য্যন্তই রইল। মেয়েটি আশ্রমে থেকে গেল। দু'বেলা যাতে আনন্দবাজারে প্রসাদ পেতে পারে তার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর আনন্দবাজার কর্ম্মীদের ব'লে দিলেন। এইভাবে দিন কাটতে লাগল। মেয়েটি যতক্ষণ পারে শ্রীশ্রীঠাকুর সান্নিধানেই থাকে।
       কিছুদিন পর মেয়েটির বাবা-মা আশ্রমে এসে পৌঁছালেন। মেয়ে যে শ্বশুরবাড়ি থেকে রাগারাগি ক'রে বেরিয়ে এসেছে, এই খবর পাওয়ার পর তাঁরা নানা জায়গায় মেয়ের খোঁজ করছেন। তারপর ঠাকুরবাড়ি আসতে পারে অনুমান ক'রে ওঁরা ঠাকুরবাড়িতেই চ'লে এসেছেন। এবার মেয়েকে ঠাকুরের কাছে দেখে ওঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর মেয়েকে বিশেষ ক'রে বোঝালেন, যাতে মেয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি যেয়ে ঘর সংসার করে। কিন্তু মেয়ে তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে শ্বশুরবাড়ি কিছুতেই যাবে না।
       মেয়ের বাবা-মা ঠাকুরের কাছে যেয়ে সব বললেন। শুনে ঠাকুর বললেন---- "ও যদি না যেতে চায়, তোরা জোর করছিস্ কেন ?"
       শ্রীশ্রীঠাকুরের ঐরকম কথা শুনে মেয়েটির বাবা-মা আর বেশি কিছু বললেন না। মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, ঠাকুর তো আছেন, এইরকম ভাবতে ভাবতে দু'দিন আশ্রমে কাটিয়ে তারা বাড়ি ফিরে গেলেন।
       আরো কিছুদিন এইভাবে কাটে। মেয়েটি দু'বেলা আনন্দবাজারে প্রসাদ নেয়, আর বেশির ভাগ সময় শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছেই বসে থাকে। কয়েকদিন পর মেয়েটির শ্বশুর-শাশুড়ী আশ্রমে আসেন। তাঁদের দেখেই মেয়েটি একটু সঙ্কুচিত হ'য়ে পড়ে। দেখে মনে হ'ল, সে যে গোলমাল ক'রে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, এতদিন পর শ্বশুর-শাশুড়ীকে হঠাৎ সামনে দেখে তার সেই অপরাধ সম্বন্ধে চেতনা ফিরে এসেছে। লজ্জাবোধ হয়েছে। অবশ্যে, এর পশ্চাতে দয়াল গুরুর উপর বিশ্বাস ও ভালবাসা নিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে থাকাটারও একটা বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সেই মহাপ্রেমের মহাসাগরে অবগাহন করে মেয়েটির মনের যাবতীয় ঈর্ষ্যা-দ্বেষ, ঘৃণা-বিতৃষ্ণা, জ্বালা-যন্ত্রণা বুঝি এবার ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে।
       সময় বুঝে শাশুড়ী মেয়েটিকে কাছে ডাকেন। নিরালায় নিয়ে গিয়ে কথা বলেন। হয়তো এর মধ্যে পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুরের ইঙ্গিত থাকতে পারে, তা আমরা জানি না। শুধু দেখলাম, শাশুড়ী-পুত্রবধূ অনেকক্ষণ ধ'রে 'প্রাইভেট' কথাবার্ত্তা বললেন। দিনের মধ্যে খেপে-খেপে কয়েকবার একরকম কথা চলল।
       পরদিন সকালে মেয়েটি এসে ঠাকুর-প্রণাম ক'রে বলল, 'ঠাকুর ! আমি এবার শ্বশুরবাড়ি যাব।' মৃদুহাস্যে অতি আনন্দে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "ভালই তো, যা। ওরা তো তোকে নিতেই এসেছে। তা'হলে এবার লক্ষ্মীটির মত শাঁখা-সিন্দুর পরে নে।" মেয়েটি সলজ্জভাবে চ'লে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে শাঁখা-সিন্দুর পরা লক্ষ্মী গৃহবধূটির মত এসে প্রণাম করে বিদায় নিল।
       জনৈক ভক্ত জানতে চাইলেন দয়ালের এই অত্যদ্ভূত লীলার তাৎপর্য্য। সোজাসুজি কোন উত্তর না দিয়ে দয়াময় শ্রীশ্রীঠাকুর মেয়েটির কোষ্ঠীর খোঁজ করতে বললেন। বহু সৎসঙ্গী ছেলেমেয়েদের কোষ্ঠী এখান থেকে করানো হয়। এই মেয়েটিরও হয়েছিল। পণ্ডিত মশাই তাঁর খাতা থেকে মেয়েটির কোষ্ঠীর ছক বের ক'রে কোষ্ঠী-বিচার করলেন। জানা গেল, যে-সময় ময়েটি এখানে চ'লে আসে এবং ঠাকুরের কাছে থাকে, ঐ 'পিরিয়ড'-এই ছিল তার বৈধব্যযোগ। কোষ্ঠী বিচারে এটাও জানা যায় যে এর খণ্ডন একমাত্র দৈবকৃপাতেই হ'তে পারে।
       এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণীয় যে, জ্যোতিষশাস্ত্রে যেমন কুগ্রহের প্রভাব, ফল আদি লেখা থাকে, তেমনি লেখা থাকে, 'কিং কুর্ব্বন্তি গ্রহাঃ সর্ব্বে যস্য কেন্দ্রে বৃহষ্পতিঃ।' এই বৃহষ্পতি হচ্ছেন বৃহৎপতি (সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পালনকর্ত্তা), অর্থাৎ গুরু বা ইষ্টদেব। তাঁকে যদি কেউ জীবনকেন্দ্রে রেখে চলে, গ্রহের অবশ্যম্ভাবী কুফলও তার ব্যর্থ হ'য়ে যায়।
       একদিন সকালে শ্রীশ্রীঠাকুর পার্লার গৃহের দক্ষিণপূর্ব্ব কোণের চৌকিখানিতে সমাসীন। কিছুক্ষণ আগে সমবেতভাবে প্রাতঃপ্রণাম হ'য়ে গেছে। শান্ত পরিবেশ। কালীষষ্ঠীমা (বয়স অনুমানিক সত্তর বছর) প্রণামের পরে বাড়ি চ'লে গিয়েছিলেন। এখন গজগজ করতে করতে ফিরে এসে বসলেন। বলছিলেন তাঁর তৃতীয় পুত্র সুরেশের কথা। পাবনার ভাষায় ঠাকুরকে বললেন, 'ঐ পাগল (সুরেশ সাহা) কী কাণ্ড আরম্ভ করিছে ! সকালে উঠে বাড়ির লোকগুলোরে ঘরে তালা দিয়ে আটকায়ে চাবি নিয়ে বারায়ে আসিছে। এখন এতগুলো মানুষ ! তাদের পেচ্ছাপ-পায়খানা আছে, সকালের কাজ আছে। কত ক'রে বুঝায়ে বললাম। ও কারো কথা কানে নেবে না। চাবি পকেটে ক'রে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন উপায় কি ?'
       ঠাকুর সব শুনলেন। শান্তভাবে ব'সে তামাক খাচ্ছেন। কোন কথা বলছেন না। কালীষষ্ঠীমা উসখুশ করছেন।
       ইতিমধ্যে সুরেশদা এসে উপস্থিত। শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে বললেন, "এই সুরেশ, তুই বলে ঘরে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে আইছিস্ ?" সুরেশদা গরম হ'য়েই ছিল। (সম্ভবতঃ বাড়িতে গোলমাল হয়েছে)। বলল, 'চাবি আমি উয়েদের দেব না। যা পারে করুক গে।' কালীষষ্ঠীমা অসহায়ের মতন শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে তাকিয়ে ব'লে উঠলেন, 'ঐ শোনেন।' শ্রীশ্রীঠাকুর নীরবে তামাক সেবন করছেন, যেন সাক্ষীস্বরূপ সব দেখছেন। সুরেশদা আপন মনে বকবক ক'রে চলেছে।
       শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দ্দেশে যতি-আশ্রমের সামনের প্রাঙ্গণে কয়েকটি চেরীগাছ লাগানো হয়েছিল। এখন গাছগুলিতে ফল ধরেছে। ঠাকুরের এখান থেকে গাছগুলি বেশ দেখা যায়। হঠাৎ সুরেশদার দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষণ করে ঠাকুর বললেন, "এই, ঐ চেরীগাছে যে ফল ধরেছে, সেগুলো মুখে দিয়ে দেখে আয় তো মিষ্টি কিনা !"
       সুরেশদা ঠাকুরের আদেশ মতো লম্ব-লম্বা পা ফেলে চেরীগাছের দিকে চলে গেল।
       এদিকে কালীষষ্ঠীমা দু' একবার বলার চেষ্টা করলেন যে এখন তিনি কী করবেন, সুরেশদার পাগলামি ও দুরন্তপনার সাথে কেউ পেরে উঠছেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখেমুখে কোন ভাবান্তর নেই। তিনি অন্যদের সাথে কথায় ব্যস্ত। কালীষষ্ঠীমার কথায় তাঁর কোন আগ্রহ নেই এবং এ-ব্যাপারে তাঁর করণীয়ও কিছু নেই, যাদের বাড়ির ব্যাপার তারাই সামলে নিক, ----বাহ্যতঃ শ্রীশ্রীঠাকুরের আচরণ থেকে এমনটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু মহাচৈতন্যের অধীশ্বর যিনি, জগৎ-সংসারে ক্ষুদ্রতম সাড়াটিও যে তাঁর দৃষ্টির বাইরে নেই তা' বোঝা গেল ক্ষণকাল পরেই। এই আপাত-সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া যে শ্রীশ্রীঠাকুর সুকৌশলে শুরু করে দিয়েছেন অনেকক্ষণ পূর্ব্বেই তা এখানে উপস্থিত কেউ বুঝতেই পারেনি।
       একটু পরেই দেখা গেল, সুরেশদা চেরীফল খেতে খেতে পার্লারের দিকে আসছে। হাতে আরো কয়েকটি পাকা চেরীফল। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে সানন্দে মাথা নেড়ে বলল, 'হ্যা, মিষ্টি আছে।' বলেই পকেট থেকে চাবির গোছা বের ক'রে শ্রীশ্রীঠাকুরের সন্মুখে উপবিষ্টা কালীষষ্ঠীমার সামনে ছুড়ে দিয়ে বলল, 'এই নে তোর চাবি !' তারপর একপাশে যেয়ে চুপ ক'রে বসল।
       কালীষষ্ঠীমা হাঁ করে দেখছিলেন সব ঘটনাগুলি। আমরাও অবাক ! এ কী 'ট্রিটমেন্ট' ! কিসের থেকে কি হ'য়ে গেল ! সামান্য কয়েকটা চেরীফল খাইয়েই একজন ছিটগ্রস্তকে পথে আনলেন দয়াল ঠাকুর। বাহ্যতঃ আর তো কিছু করতে দেখা যায়নি। এমন চিকিৎসা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। তাইতো তাঁর উপমা একমাত্র তিনি।
       একবার একটি আমেরিকান যুবক---- জন মাইকেল---- আশ্রমে বেড়াতে এলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি ওঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ক'রে দিলেন। মাইকেল আশ্রমে ঘোরাফেরা করে। ভক্তদের সাথে শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনাও করে। বড়লোকের ছেলে। তার বেশভূষাও তেমনতর। তার হাতে একটি চমৎকার সৌখিন ঘড়ি, সবসময় জ্বল্‌জ্বল্‌ করছে। মাইকেল বলেছিল, এই ঘড়িটা তার খুব প্রিয়। দাম জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আড়াইশো ডলার। তারপর একদিন মাইকেল দীক্ষা নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। শ্রীশ্রীঠাকুর ননীদাকে (চক্রবর্ত্তী) দীক্ষা দিতে বললেন।
       দীক্ষার পর ননীদা মাইকেলকে সাথে নিয়ে এসে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রণাম করে বলছেন, 'দীক্ষা হ'য়ে গেছে।' ভারতীয় প্রথায় ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল মাইকেল। তারপর হাত থেকে প্রিয় ঘড়িটা খুলে নিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে এগিয়ে ধরে বলল, 'এই আমার ঠাকুর-প্রণামী।' শ্রীশ্রীঠাকুর সাগ্রহে ঘড়িটি হাতে নিয়ে ব'লে উঠলেন, "এটা আমার ? এটা আমার ? বাঃ !" আনন্দে মনপ্রাণ ভরে পড়েছে তাঁর। ভাবখানা এমন, যেন জীবনে তিনি এত ভাল ঘড়ি দেখেন নি এবং এই ঘড়িটা পেয়ে একেবারে ধন্য হ'য়ে গেছেন। তারপর হাতে ক'রে কিছুক্ষণ ভালভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর খুশীতে তাঁর চোখমুখ যেন আরও উপ্‌চে পড়ল। পরক্ষণেই তিনি স্নেহভরে মাইকেলের হাতখানা টেনে নিলেন এবং তার হাতে ঘড়িটি স্বহস্তে পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, "এটা আমার ঘড়ি, বুঝলে তো ! তোমার কাছে থাকল।" বিস্ময়ে অভিভূত ঐ ধনী আমেরিকান যুবক। এমনতর অন্তরস্পর্শী বিচিত্র ব্যবহার সে প্রত্যাশা করা তো দূরের কথা, বোধ হয় কখনও চিন্তাও করে নি।
       একটি মায়ের ছেলের 'টি-বি' হয়েছে। বর্ত্তমানে সে হাসপাতালে আছে। চিকিৎসার ফলে রোগ কিছুটা ভালর দিকে। এখন ডাক্তার বলছেন, ছেলের মাছ, ডিম আদি খেতে হবে, নতুবা রোগ ভাল হবে না। কিন্তু ছেলেটি তথা তার পরিবারের সকলেই নিরামিশাষী। মা-টি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে বললেন ডাক্তারের কথা। শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "মাছ-মাংস খেয়ে যে রোগ ভাল হয় তা আমি জানি না। ও না খাওয়াই ভাল। বরং সেই পয়সায় ফল, দুধ, ছানা যেমন সহ্য হয় তাই খাওয়াবার ব্যবস্থা করা ভাল।" মা-টি আবার বললেন, 'কিন্তু ওর যে রোগ হয়েছে তাতে মাছ না খাওয়ালে ছেলে বাঁচানো যাবে না যে।' অতি শান্ত অথচ অকম্পিত কণ্ঠে উত্তর করলেন শ্রীশ্রীঠাকুর, "তা' না হয় মরেই গেল। কিন্তু আমি বলছি, ও খাওয়ালে ভাল হবে না।" তাঁর বলার ধরণ দেখে মায়ের হৃদয় স্থির হ'ল, বিশ্বাস ফিরে এল। ছেলের জন্য তিনি নিরামিষ আহারের ব্যবস্থাই রাখলেন।
       বলা বাহুল্য যে, ডাক্তারদের অবাক ক'রে দিয়ে ঐ ছেলে অতি স্বল্পকালের মধ্যে সুস্থ হ'য়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এল।
       দেওঘরে শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রিতজনদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাঁর মাসতুত ভাই হরিদাস ভট্টাচার্য্য। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে শুনেছি, এই হরিদাস ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ও দুঃসাহসী ছিলেন। আবার, ঠাকুরের ওপর তাঁর ভালবাসাও ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর একদিন গল্প করছিলেন, "(পাবনায়) আমি যখন বড়-বৌকে নিয়ে ভাটিবনের দিক দিয়ে বেড়াতে যেতাম, তখন হরিদাস একটু দূরে দূরে থেকে একটা রাম-দা নিয়ে আমাদের পাহারা দিত। সাহস ছিল খুব... ... ... আবার স্কুলে দুষ্টামি ক'রে মারও খেত। মাষ্টার মশাই যখন মারত, তখন বেতের এক বাড়ি খেয়ে 'ওরে আল্লা ! ওরে আল্লা !' ক'রে লাফাত।" ঐ-সময় হরিদাসদা যেরকমভাবে অঙ্গসঞ্চালন করতেন, তা' অভিনয় ক'রে দেখালেন শ্রীশ্রীঠাকুর। শ্রীশ্রীঠাকুরের অভিনয় দেখে হাসির ফোয়ারা ছুট্‌ল সকলের।
       পরবর্ত্তীকালে আমরা পরিণত বয়সের হরিদাসদাকে দেওঘরে দেখেছি। তখন তিনি মোটামুটি শান্ত। তবে রেগে গেলে খুব গালাগালির বহর ছুটাতেন।
       দুপুরে শ্রীশ্রীঠাকুর বিশ্রাম থেকে উঠলে হরিদাসদা রোজই এসে বসতেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে। কাছাকাছি একখানা চেয়ার ওঁর জন্য পাতাই থাকত, তাতেই বসতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করতেন, টুকিটাকি কথাবার্ত্তাও চলত। ঘন্টাখানেক ব'সে থেকে হরিদাসদা উঠে বাড়ী চ'লে যেতেন।
       ইং ১৯৫৪ সাল, শ্রীশ্রীঠাকুর তখন ঠাকুরবাংলার অভ্যন্তরে 'নিভৃত-কেতন' নামক বাসগৃহে অবস্থান করছেন। দুপুরে বিশ্রামের পর শ্রীশ্রীঠাকুর ঐ ঘরের পূবের বারান্দায় এসে বসেছেন। হরিদাসদা তাঁর সময়মত যথারীতি এলেন। সেদিন কোন কারণে হরিদাসদার মাথা গরম ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুরের সাথে তিনি উত্তেজিত স্বরেই কথা বলছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর অবশ্য শান্তভাবেই উত্তর দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় হঠাৎ হরিদাসদা রূঢ়ভাবে বলে ফেললেন, 'আমরা তো তোমার 'স্লেভ' slave (ক্রীতদাস)।' শোনামাত্র গর্জ্জন ক'রে উঠলেন শ্রীশ্রীঠাকুর---- "স্লে----ভ্ ?" তারপর চৌকি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে হরিদাসকে বললেন, "'গেট্ আউট্', 'গেট্ আউট্' (বেরিয়ে যাও)।" ব'লে বাথরূমে চ'লে গেলেন।
       হৃদয়ের অপরিমেয় ভালবাসা ঢেলে যিনি জীবজগতের মঙ্গল সাধন ক'রে চলেছেন, মানুষের সুখ-দুঃখকে যিনি নিজেরই সুখ-দুঃখ ব'লে বস্তব বোধ করেন, সেই নিঃস্বার্থ অকুণ্ঠ প্রেম হয়েছে প্রত্যাখ্যাত ও অবমানিত। প্রেমাবতার যিনি, তিনি যুগে যুগেই এইভাবে অজ্ঞতা ও সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতার কাছে অবজ্ঞাত হ'য়ে থাকেন। এতে তাঁর প্রাণে ব্যথা লাগে। লেগেছে আজও হরিদাসদার এই ব্যবহারে। তাঁর ঐ গর্জ্জন---- আক্রোশের বা অহং-এর বহিঃপ্রকাশ নয়। বাহ্যতঃ তাই মনে হ'তে পারে। আসলে এ হ'ল অবহেলিত প্রেমের ব্যাথাভরা হাহাকার।
       শ্রীশ্রীঠাকুরের এরকম ভাবান্তর হরিদাসদা বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেন নি। তিনি কোন কথা না ব'লে চেয়ার ছেড়ে উঠে লাঠিখানা ঠুক ঠুক করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের হুঙ্কার শুনে আশ্রমবাসী অনেকে ছুটে এসেছেন। কাছেই একটা টিনের ঘরে থাকতেন ব্রজগোপাল দত্তরায়। সম্প্রতি তাঁর পাইল্‌স্ অপারেশন হয়েছে। হাঁটা তাঁর পক্ষে কষ্টকর। তবুও তিনি গুটি-গুটি চলে এসেছেন ব্যাপার কী দেখার জন্য।
       শ্রীশ্রীঠাকুর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, "হরিদাস গেল কোথায় ?" তাঁর চোখমুখ তখন প্রশান্ত, চোখের কোণে যেন একটু প্রচ্ছন্ন দরদমেশানো কৌতুকের ঝিলিক।
       একজন বললেন, 'উনি চ'লে গেছেন।' শুনেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "ডেকে আন্।" সে দৌড়ে চ'লে গেল।
       ইতিমধ্যে ব্রজগোপালদার দিকে চোখ পড়তেই শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি এসেছেন কেন ?" ব্রজগোপালদা---- 'এই গোলমাল শুনে এলাম।' যেন কিছুই হয়নি এই ভাব নিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বাভাবিকভাবে বললেন, "ও কিছু না। হরিদাসকে একটু বকলাম। যান, আপনি ঘরে যান।"
       হরিদাসদা অনেকটা রাস্তা চলে গিয়েছিলেন। ঐ লোকটি যেয়ে বলতে আবার ফিরে এলেন। আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আদরভরা স্বরে বললেন, "তুই চলে গেলি কেন ? তোদের কি একটু বকতেও পারব না ?"
       হরিদাসদা হতভম্ভ। শ্রীশ্রীঠাকুরের পূর্ব্বের মূর্ত্তি যেমন তাঁর কাছে অকল্পনীয়, বর্ত্তমানের রূপটিও ঠিক তেমনিই অচিন্তনীয়। তাই, তাঁর মুখে আর বাক্যস্ফূর্ত্তি নেই। চুপচাপ এসে চেয়ারে বসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর গড়গড়ার নলটি হাতে নিয়ে শান্তভাবে তামাক সেবন করতে লাগলেন এবং অন্যদের সাথে কথাবার্ত্তা কইতে লাগলেন। একটু আগের উত্তেজনার চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।
       একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর সুধাপাণিমাকে বললেন সতু সান্যালকে ভাল করে খাওয়াতে। তদনুযায়ী সুধাপাণিমা ভাল ভাল রান্না ক'রে সতুদাকে খেতে বলেছেন।
       সতুদাকে সেদিন খেতে বসিয়ে দিয়ে সুধাপাণিমা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে জানালেন, 'সতুদা খাচ্ছে।' ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বললেন, "সে খাচ্ছে আর তুই চলে এলি যে ? শীগগীর যা। মানুষকে খেতে দিয়ে তার সামনে থাকতে হয়। কখন কী লাগে ?" সুধাপাণিমা তাড়াতাড়ি গেলেন সতুদার কাছে।
       বহুকাল ধরে আমাদের দেশে এই প্রথাটি চলে আসছে, ----নিমন্ত্রিত অতিথিকে খেতে বসিয়ে গৃহের কর্ত্তা বা কর্ত্তৃী স্বয়ং তাঁর সামনে উপস্থিত থাকেন, কখন কার কী প্রয়োজন বুঝে পরিবেশন করেন এবং প্রীতিকর কথা ব'লে মনে আনন্দ দান করেন। তাতে যিনি খাচ্ছেন, তাঁর খাওয়াটা তৃপ্তিপ্রদ হয়।
       শ্রীশ্রীঠাকুর চান এই প্রথার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক বেড়ে উঠুক। কালবশে এই মাঙ্গল্য প্রথাটি আমরা যাতে ভুলে না যাই, শ্রীশ্রীঠাকুর সে-বিষয়ে সজাগ করে দিলেন।
       ঠাকুর বাংলায় বর্ত্তমান নিরালা-নিবেশ গৃহটির উত্তর-পশ্চিমে একটি বেলগাছ ছিল। ঐ বেলতলা দিয়ে হেঁটে এসে শ্রীশ্রীঠাকুর বসতেন অশত্থতলার ছোট একটি ছাউনিতে। বেলগাছটা ছিল অনেক পুরানো। তার একটি শিকড় যাওয়া-আসার পথের উপরেই মাটি ফুঁড়ে খানিকটা উঠে যেয়ে আবার মাটির মধ্যে নেমে গেছে।
       একদিন যাওয়ার সময় ঐ শিকড়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের হোঁচট লাগল। বঙ্কিমদা (রায়) শ্রীশ্রীঠাকুরের হাত ধ'রে নিয়ে আসছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর ছাউনির তলে পাতা শয্যায় বসার পর বঙ্কিমদা কাঠের কারখানায় একজন মিস্ত্রিকে ডাকতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর করাত নিয়ে মিস্ত্রি এসেছে, মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা বেলগাছের ঐ শিকড়টা কাটা হবে। হঠাৎ মিস্ত্রিকে দেখতে পেয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বঙ্কিমদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, "কি হবে রে ?"
       বঙ্কিমদা দেখেছিলেন, ঠাকুরের চলার পথে শিকড় গজিয়েছে। তাঁর একবার হোঁচট লেগেছে, আবারও লাগতে পারে। অতএব, ওটা কেটে ফেলাই দরকার। তাই, তিনি মিস্ত্রিকে ডেকে এনেছেন। ভেবেছিলেন, শ্রীশ্রীঠাকুর জানতে পারবেন না এইভাবে শিকড়টি কাটিয়ে দেবেন। এখন শ্রীশ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করায় খানিকটা আমতা-আমতা ক'রে বললেন, 'না, ঐ যে শিকড়টা উঁচু হ'য়ে আছে, আপনার পায়েও লাগল। ওটা কাটিয়ে দেব ভাবছি।'
       একথার উত্তরে সৃজন সংরক্ষক পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর যা বললেন তা অচিন্তনীয়, অশ্রুতপূর্ব্ব। বিশ্বপ্রেমের সর্ব্বোচ্চ সংজ্ঞা ব'লে যদি কিছু থাকে তাকেও বুঝি তা' হার মানায়। বঙ্কিমদার চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, "তুই যখন হাত দিয়ে আমাকে ধরিস্, তোর কনুইটাও তো মাঝে-মাঝে উঁচু হয়ে আমার পাঁজরে লাগে, ব্যথা করে। তা তোর হাতখানা যদি কেটে দিই তাহলে কেমন হয় ?" ব্যাস, বঙ্কিমদা চুপ। ইঙ্গিতে মিস্ত্রিকে চ'লে যেতে বললেন। শিকড় কাটা অধ্যায়ের এখানেই পরিসমাপ্তি।
       বিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধের সুরু থেকেই বিশ্ব আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় কম্পমান। কখন কোথায় আণবিক বিস্ফোরণ ঘটবে তার ঠিক নেই। আণবিক তেজস্ক্রিয়তা বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয়। বিস্ফোরণক্ষেত্র থেকে দূরে থাকলেও মানুষ তেজস্ক্রিয়তার শিকার হতে পারে। এইসব নিয়ে একদিন আলোচনা চলছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে। কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "আণবিক তেজস্ক্রিয়তা ঠেকানো যায় থৈকলে।" জিজ্ঞাসা করা হল থৈকল কী ! উত্তরে বললেন ঠাকুর, "থৈকল একরকম ফল। আসামের ওদিকে পাওয়া যায়। খুব টক। অম্বল রেঁধে খাওয়া যায়। বড়-বৌ এর কাছে থাকতে পারে। দেখে আয় তো !"
       একজন শ্রীশ্রীবড়মার কাছে যেয়ে থৈকল ফলের কথা বলতেই শ্রীশ্রীবড়মা তাঁর ভাঁড়ার থেকে থৈকল বের করে দিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এনে দেখানো হল। কাটা-কাটা অংশ, শুকিয়ে গেছে। পরে জানা গেল আসামের জঙ্গলে এবং উত্তরবঙ্গের কোন কোন জায়গায় থৈকল গাছ আছে।
       এইরকম অসংখ্য ঘটনার স্রোত নিরন্তর আবর্ত্তিত হয়েছে দয়াল ঠাকুর শ্রীশ্রীঅনুকূলচন্দ্রকে কেন্দ্র ক'রে। তার কতটুকু বা ধ'রে রাখা গেছে ! এই নিবন্ধটি সেই মহাসমুদ্রের অতি সামান্য কয়েকটি বিন্দু চয়ন ক'রে ঐ লোকত্তর ব্যক্তিত্বের কিছুটা উপলব্ধি করার প্রয়াস মাত্র।

                         সমাপ্ত----.

*** [উক্ত লেখাটি - 'সৎসঙ্গ' - দেওঘর, ঝারখণ্ড থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা 'আলোচনা', আশ্বিন---- ১৩৯৯ (৪৪ বৰ্ষ, একাদশ সংখ্যা, অনুকূলাব্দ- ৪৭)-এর শ্ৰীদেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রচিত 'দয়াল ঠাকুর' নামক নিবন্ধ থেকে নেওয়া।]

Comments

Popular posts from this blog

Tumi Jemon Kore Chalate Chao Lyrics

Tumi Jemon Kore Chalate Chao Lyrics    Tumi Jemon Kore Harmonium Tutorial Tmi jmn kre chalate Chao chalte pri na Mnr majhe Nitya jge Hajar bahana. Tmr kache peye peye Kate amr Bela Kichui to hay hayna kra sudhui abahela. Tmr chinta kmn kre rakhbe Amy urddhe dhare Ami to hay tmn kre chalte prina. Tmr mnr Mata kre Dayal Amay nao kre Chaluk bisva bhuban jure chaoya haoyar khala. Dhana Dhanya Lyrics

Dhana Dhanya Lyrics

 Dhana Dhanya Lyrics Dhana Dhanya Harmonium Tutorial Bengali: ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি। চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা, কোথায় উজল এমন ধারা কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকেজেগে। এত স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড় কোথায় এমন হরিত ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে। পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখি ...

Praner Thakur Sri Anukul Lyrics

Praner Thakur Sri Anukul Lyrics Praner Thakur Sri Anukul Harmonium Tutorial   প্রাণের ঠাকুর শ্রী অনুকূল তুমি জীবের মূল আমার অনুকূল তোমার পূজা করবো বলে তুলেছি ফুল ঠাকুর অনুকূল আমার শ্রী অনুকূল।। এসো হে দয়াময় অনুকূল তুমি ছাড়া এ সংসারে সবই দেখি ভুল তুমি নিজ গুনে কৃপা করে দাও চরণযুগল প্রাণের ঠাকুর শ্রী অনুকূল ..... হৃদমাঝারে দাঁড়াও এসে ও হরি তোমার পূজা করবো নিষ্ঠা ভক্তি ভরি আমার নয়ন জলে ধুয়ে দেব চরণ কমল প্রাণের ঠাকুর শ্রী অনুকূল ...... গৌতম বলে মায়ার খেলা কতকাল কৃপা দৃষ্টি দিয়ে কাটো ভয় মায়াজাল আমার পিঞ্জিরায় ওই পাখিটি আজ হয়েছে ব্যাকুল প্রাণের ঠাকুর শ্রী অনুকূল.... Hathat Jere Ghor Legeche Lyrics

Buy Your Favourite Satsang Books