মেয়েরা পুরুষের আশ্রয়স্বরূপ—দুর্গস্বরূপ
ঠাকুর একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন—মেয়েদের সঞ্চয় বুদ্ধিও দরকার। যখনই সুযােগ পায়,
তখনই মেয়েরা যদি কিছু-কিছু সঞ্চয় করে রাখে, তাহলে বিপদে-আপদে সেটা অমৃতের মতাে
কাজ করে। বড়বৌকে তাে আমি বিশেষ কিছুই দিতে পারি না, কিন্তু ও যখন যা পারে জমিয়ে
রাখতে চেষ্টা করে। আমি আবার অসুবিধায় পড়লে তার কাছে হাত পাতি, এক-এক সময় বড়
ঠেকায়—বাঁচায়। তাই তােমাদের খুব ভাল শিক্ষা হওয়া চাই। তাহলেই তােমরা পুরুষের
আশ্রয়স্বরূপ, দুর্গস্বরূপ হয়ে উঠতে পারবে। বাইরের ঝড়ঝাপটা তাদের বিধ্বস্ত করতে পারবে
। স্বাস্থ্য বল, কর্মশক্তি বল—সবই তাদের ফুটে উঠবে। নারীত্বের সার্থকতা মাতৃত্বে। প্রকৃত
মাতৃত্বের স্ফুরণ যখন হয় মেয়েদের মধ্যে, তখন স্ত্রীর ভিতর দিয়েও স্বামী মাতৃত্বের স্পর্শ পায়।
সন্তানের সুস্থি ও পুষ্টির জন্য মায়েরা যেমন একটা পাগলপারা রকম থাকে, স্বামীর জন্যও তখন
তেমন হয়। মা যাওয়া অবধি বড়বৌয়ের মধ্যে এই জিনিসটা আমি খুব বেশি করে দেখছি।
বেশিরভাগ সময় থাকে তাে বাড়ির মধ্যে, কিন্তু আমি দেখি। তিনটে হাঁচি যদি দিই—তাও সে
খবর রাখে। হয়তাে খেতে বসেছি, টক খাবাে, বললাে—আজ আর টক খেয়ে কাজ নেই, বার
বার হাঁচি হচ্ছে যেমন। রকমটা দেখে আমার ভাল লাগে। মেয়েরা স্বামী পুত্রকে এমনি করে
স্নেহপ্রীতি ও সেবার বেষ্টনে আগলে রাখে বলে তারা সুস্থ থাকে, কর্মঠ থাকে। দীর্ঘজীবী হয়।
নইলে কি তাদের উপায় ছিল ? (সূত্র : আলােচনা প্রসঙ্গে, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ ১১৫)
আরও একটি ঘটনা শ্রীশ্রীবড়মার সঞ্চয়ী মনােভাবের সম্যক পরিচয় দেয়। একবার শ্রীশ্রীঠাকুর
শ্রদ্ধেয় শরৎ হালদার-দার কাছ থেকে পঁচিশটা মােহর চেয়েছিলেন। শরৎদা এই ব্যাপারে একটু
অসুবিধার মধ্যে পড়ায় এবং সেটি শ্রীশ্রীবড়মার কর্ণগােচর হওয়ায় তিনি শরৎদাকে ডেকে
শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেবার জন্য পঁচিশটা স্বর্ণমুদ্রা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। যে জিনিস তিনি
শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য তিল তিল করে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন তারই প্রয়ােজনে তাঁরই সেবায়
এককথায় তারই কাজে লাগিয়েছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর যে বড়মার সংরক্ষণী বৈশিষ্ট্যের কথা
বলেছিলেন, এই ঘটনাটি তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শ্রীশ্রীবড়দা ছিলেন তার অল্প বয়সের সন্তান, অন্যান্য সন্তানদেরও তিনি ধারণ, পালন ও
পােষণের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দচিত্তে মানুষ করে গেছেন। একান্ত আড়ম্বরশূন্য এবং কোনরূপ
প্রয়ােজনহীনতাই ছিল তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গৃহকর্ম ছিল তাঁর নিত্যকার কর্ম।
আর তার জীবনটা ছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য উৎসর্গীকৃত। মাত্র এগারাে বছর বয়সে শ্বশুরালয়ে
এসে যে একক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সংসারটাকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলেছিলেন। পরবর্তী
জীবনে তাঁর সংসারে লােকসম্পদ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও গৃহকর্ম থেকে কখনও বিরত হননি।
টানা দীর্ঘ এক ঘােমটায় তার মস্তক আচ্ছাদিত থাকত, রাত থাকতে শয্যা ত্যাগ করতেন, তারপর
স্নান ও প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করে, নাম-ধ্যান-বিনতি প্রার্থনা শেষে ঠাকুরপূজা করে সংসারের
রান্নাবান্না চড়াতেন। খুব তাড়াতাড়ি-ই তার রান্নাবান্না হয়ে যেত। তারপর সারাবেলা ধরে চলতাে
ভক্ত, অতিথি ও অভ্যাগতদের পরিচর্যা ও আপ্যায়ন। এ ব্যাপারে যত রকমের চাপ বা লােক
আপ্যায়নের ঝড় তার শাশুড়ি দেবী ও স্বামীর কাছ থেকে আসতাে সবকিছুই তিনি সাহসের
সঙ্গে মােকাবিলা করতেন। কোনরকম ওজর-আপত্তি, অভাব-অভিযােগ তিনি তাে করেন-ই-নি,
এমনকি কোনদিন তাকে ভূকুঞ্চন করতেও কেউ দেখেননি। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন লক্ষ্মীমা।
Comments
Post a Comment