মহাজীবনের মহাপ্রয়াণ
তারপর এলাে সেই সাতাশে জানুয়ারী ঊনিশশাে ঊনসত্তর সালের মাঘ মাসের নবমী তিথি।
আজও অন্যান্য দিনের মতােই ঠাকুর বড়দা বড়মা বেড়াতে গেলেন মানিকপুরে। বড়দা বন
থেকে করমচা ও বনকুল নিয়ে এসেছেন। ঠাকুর ও বড়মার হাতে দিলেন। ঠাকুর ও বড়মা
করমচা খেলেন। তারপর বেলা দশটায় বড়দা ঠাকুরকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। ঠাকুরের
স্নান ও ভােগ যথারীতি সম্পন্ন হল। দুপুরে ভালভাবে বিশ্রামও নিলেন। বিকালে পার্লারে বসে
আছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। আধাে আলাে ও আধাে আঁধারে রহস্যঘন। ঠাকুর প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন
তার আশি বছর কবে পূর্ণ হবে। এবছরে ঠাকুর একাশি বছরে পদার্পণ করেছেন। রাত্রে কয়েক
ঘণ্টা ঘুমালেন। রাত এগারােটায় ঘুম ভেঙে গেল। শারীরিক যন্ত্রণা হচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছে
কি সেই যন্ত্রণা। পৃথিবীর সব দুঃখের ধারক বাহক যিনি, যিনি নীলকণ্ঠ, তাঁকে যে যন্ত্রণা
বুকে ধারণ করতেই হবে। তিনি তাে পৃথিবীর সমস্ত বিষ পান করে নিজে নীলকণ্ঠ হয়ে পৃথিবীকে
অমৃত দান করে গেলেন। ভাের চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে দিব্য জীবনের দিব্য লীলার মহাসমাপন
হল। মহাজীবনের হল মহাপ্রয়াণ। রেখে গেলেন বিপুলা পৃথিবী, অগণিত ভক্ত আর তার
মহাজীবনের দিব্যবাণী।
বড়মাকে বিশ্বজননীর আসন দিয়ে গেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ৬ই চৈত্র মাতা
মনােমােহিনী দেবী যখন ইহজীবন ছেড়ে চলে গেলেন। ঠাকুর তখন মাতৃশােকে পাগল, মাতৃহারা
বেদনায় পাবনার গােটা আশ্রম তখন শােকে জর্জর। বড়মাই পরম স্নেহে, মমতায় শ্রীশ্রীঠাকুরের
মা-হারার বেদনাকে প্রশমিত করতে পেরেছিলেন। ঠাকুর সকলের সামনেই শােক-সন্তপ্ত
আশ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন—“বড়বৌ, আমাদের মা আজ চলে গেলেন। আশ্রমবাসী
দেখাে।
মাতৃহারা হল আজ! তুমি তাদের মা হও আজ থেকে। তােমার স্নেহের কোলে বিশ্রাম লভূক
আজ থেকে সকলে। আজ আর তুমি বধূ নও। আজ তুমি মা, তুমি বিশ্বজননী—তুমি এদের
(সূত্র : লক্ষ্মীমা, দ্বিতীয় খণ্ড)
বড়মা প্রায়শই বলতেন—আমি ঠাকুরের আগে যাব না। আমি আগে আগে চলে গেলে
ওনার (ঠাকুরের) কষ্ট হবে। উনিশশাে ঊনসত্তর সালের সাতাশে জানুয়ারী ঠাকুর দয়ালদেশে
চলে যাবার পর বড়মা বাকরহিত হয়ে গেলেন। আপন মনে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন সেই পরম
বৈভব সত্তার সাথে একাত্ম হওয়ার। শ্রীশ্রীবড়দা, মাকে নিয়ে, খানিকটা ভুলিয়ে রাখার জন্য,
ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। পূজ্যপাদ বড়দা তাকে পুরী নিয়ে যাবার পথে মেদিনীপুর
শহরে সৎসঙ্গের জেলা কেন্দ্রে কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। এছাড়াও ভারতের কিছু পবিত্র
তীর্থে তাঁর শুভাগমন ঘটেছিল। তিনি নাকি প্রায়শই বলতেন—বর্ষাকালে আমার জন্ম,
বর্ষাকালেই বিবাহ এবং বর্ষাকালেই আমি যাব। শেষপর্যন্ত সতি সত্যিই শ্রীশ্রীবড়মার মহান আত্মা,
পূত পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা তিথিতে (২৬শে বৈশাখ, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ) বর্ষার অবিরাম বৃষ্টির ধারার
মধ্য দিয়ে সমস্ত জগতকে কাঁদিয়ে পরমপিতার মহান আত্মার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেলেন।
Comments
Post a Comment